২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

অনুগতদের নিয়োগ দিতেই অনিয়ম

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

দলীয় রাজনীতির কারণে এবং উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করার পাশাপাশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকা প্রার্থীরাও নিয়োগ পেয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের গত তিন বছরের মধ্যে এবং নতুন বিভাগগুলোয় শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী নীল দলের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকা অংশটি নিজেদের পছন্দ ও অনুগত শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে অনেক অনিয়ম করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষকের সংখ্যা ১ হাজার ৯৯২। উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাড়ে ৮ বছরের মেয়াদে মোট ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জন এবং এবং ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই দুই বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন। আর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে দুই বা ততোধিক অতিরিক্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪১ জনের ক্ষেত্রে। স্নাতকোত্তর ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত তিনজন।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ নিয়োগ বোর্ডে সভাপতিত্ব করেছেন। তাঁর আগে সহ-উপাচার্য ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ। অনিয়মের বেশির ভাগ ঘটনাই সংবাদপত্রে প্রকাশের সময় উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বিষয়গুলোকে নিয়োগ বোর্ডের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপকভাবে অনিয়ম হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু এর পেছনে অনেক কারণও রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এমন অনিয়মের ঘটনায় শিক্ষক, সিন্ডিকেটের কোনো কোনো সদস্য লিখিতভাবে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগে ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই ছয় শিক্ষক নিয়োগ না দিতে সিন্ডিকেটের কয়েকজন শিক্ষক অনুরোধ জানান। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। শিক্ষকদের একটি অংশের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের কমিটিতে বর্তমান উপাচার্য ও প্রশাসনের শক্ত অবস্থান থাকায় সব সিদ্ধান্তই সহজে পাস হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল থেকে নির্বাচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক নিয়োগের এমন হাল নিয়ে তাঁর মতো অনেক শিক্ষকই উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে উপাচার্যকে অনেক শিক্ষকই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। সিন্ডিকেটেও বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি শুনতে চাইছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি উপাচার্য স্যারকে বলছিলাম, স্যার, আমি-আপনি একসময় এই ক্যাম্পাসে থাকব না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। শিক্ষক নিয়োগ যদি এ রকম হয়, তাহলে আমরা কাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় রেখে যাচ্ছি, তা ভাবার দরকার।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিক্ষক নিয়োগে এমন অনিয়মের পেছনে ক্ষমতাসীনদের সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কাজ করেছে। নীল দল এখন দুটি ভাগে বিভক্ত। এর একটি অংশের নেতৃত্বে আছেন উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক, অন্য অংশে আছেন বর্তমান শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামালসহ নীল দলের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা। আরেফিন সিদ্দিক তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার চেষ্টা করলে এই বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। চার বছর আগে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার পর থেকেই উপাচার্য নিজের পক্ষের শিক্ষক বাড়াতে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। এ জন্য তিনি অনেক সময় নিয়োগ বোর্ডকে প্রভাবিতও করেছেন বলেও শিক্ষকদের একটি অংশের অভিযোগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরেফিন সিদ্দিক গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এটা হতেই পারে। এ নিয়ে কথা বলার কিছু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ প্রশাসনিক পদেই আছেন উপাচার্যের আস্থাভাজনেরা। একজন একাধিক পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। অবশ্য, উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের অনেকেই বিভিন্ন সময় আরেফিন সিদ্দিকের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু চাহিদা ও মতের মিল না হওয়াতেই এখন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান নিয়েছেন।

শুরু থেকে
২০০৯ সালে আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন ১ হাজার ২০০ জন। গত সাড়ে আট বছরে ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগের মধ্যে অন্তত ১১০ জন শিক্ষক নতুন খোলা বিভাগগুলোতে যোগ দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৮৩টি বিভাগ ও ১২টি ইনস্টিটিউটে ৩৭ হাজার ১৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১ হাজার ৯৯২ জন। প্রতি ১৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন করে শিক্ষক। তবে শিক্ষকদের এখন ২৮৬ জন দেশের বাইরে ও দেশে অন্য কাজের জন্য ছুটিতে আছেন। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মোট শিক্ষক ছিলেন ১ হাজার ৮৯১ জন। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে মোট শিক্ষক ছিলেন ১ হাজার ৭১১ জন।

শর্ত শিথিল ও বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত নিয়োগ
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের প্রথম অভিযোগ আসে ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। ওই অনুষদের সাতটি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ প্রভাষকের ১৫ জনই তুলনামূলক কম যোগ্য এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-সমর্থক বলে পরিচিত। এ নিয়োগের চ্যালেঞ্জ করে প্রথম শ্রেণি পাওয়া এক শিক্ষার্থী রিট করেছিলেন।
পৃথক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার দর্শন বিভাগের শিক্ষক তোফায়েল আহমেদের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা ও বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গত বছরের ডিসেম্বরে নিয়োগ পান তোফায়েল। তিনি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী আবেদনেরই যোগ্য ছিলেন না।
সাধারণত, শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীর ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৫০ এবং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫-এর মধ্যে ৪ দশমিক ২৫ থাকতে হবে বলে উল্লেখ থাকে। তবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ৭৫ পাওয়াকেও অনেক সময় মানদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর কোনো বিভাগে কেউ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকলে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রেওয়াজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তিতে যে কটি পদে আবেদন চাওয়া হয়, তা থেকে একজন অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া যায়। অতিরিক্ত একজন নিতে হলেও নিয়োগ বোর্ডের সভার আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের সমন্বয় ও উন্নয়ন (সিঅ্যান্ডডি) কমিটির সুপারিশ লাগবে।
গত ১২ জুলাই ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগে দুটি স্থায়ী ও তিনটি অস্থায়ী পদের বিপরীতে মোট নয়জনকে নিয়োগ দেয় সিন্ডিকেট। তাঁদের আবার ছয়জনের আবেদন করারই ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না। শর্ত শিথিল করে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে সিজিপিএ-৪-এর স্থলে ৩ দশমিক ৭৫ চাওয়া হয়।
কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত নয়জনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের ছয়জন শর্ত পূরণ করতে পারেননি। তাঁরা সিজিপিএ-৩ দশমিক ৬১ থেকে ৩ দশমিক ৭১ পর্যন্ত পেয়েছেন।
তবে সবচেয়ে বড় নিয়োগ হয় ২০১৬ সালের ১৬ আগস্টের নিয়োগ বোর্ডের সভায়। সেখানে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে দুটি স্থায়ী প্রভাষক পদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১১ জনকে নেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিভাগের অভ্যন্তরীণ অস্থায়ী পদে নিযুক্ত ৪ জন শিক্ষককে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। আর নতুন নিয়োগ দেওয়া হয় ৫ জনকে।
দুই মাস পর ৩১ অক্টোবরের সিন্ডিকেটে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে নয়জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে তিনজনের কোনো স্নাতকোত্তর ডিগ্রিই ছিল না। এই নিয়োগেও সাধারণ শর্তই ছিল। তবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ নিকট অতীতে আর নেই। আর বিভাগ থেকে কোনো শিক্ষক নিয়োগের চাহিদাই ছিল না। সিঅ্যান্ডডি কমিটির কোনো চাহিদা ছাড়াই সিন্ডিকেট থেকে সরাসরি এই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। প্রথমে চারটি পদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নয়জনকে নেওয়া হয়।

বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই নিয়োগ
এর আগে ৫ অক্টোবরের নিয়োগ বোর্ডের সভায় শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগে কোনো বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই দুজনকে প্রভাষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। তখন এটি নিয়ে কয়েক পক্ষের দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন বিষয়টি ঝুলে থাকে। চারুকলা অনুষদের ডিন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। প্রায় ছয় মাস পর গত ২৬ এপ্রিলের সিন্ডিকেটে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শুধু দুটি সহকারী অধ্যাপক পদের বিষয়ে উল্লেখ ছিল। নিয়োগ পাওয়া দুই প্রভাষকের একজন শর্ত পূরণ করেননি।
২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট ফিন্যান্স বিভাগে দুজনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাঁচজন নিয়োগ করা হয়। একই বছরের ১২ জুলাই বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে দুটি শূন্য পদের বিপরীতে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞপ্তির বাইরে আরও দুজনকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয় সিন্ডিকেট। এই বিভাগে ২০১৪ সালেও বিজ্ঞপ্তির শর্ত উপেক্ষা করে দুজন প্রভাষক নিয়োগ করা হয়। তাঁদের একজনের উচ্চমাধ্যমিক ও অপরজনের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না।

শর্ত পূরণকারীরা সবাই বাদ পড়লেন
গত বছরের ২১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন খোলা মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগে চারজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের কেউই বিজ্ঞপ্তির উল্লেখিত যোগ্যতার শর্ত পূরণ করেননি। কিন্তু আবেদনকারীদের মধ্যেই শর্ত পূরণকারী প্রার্থীরা ছিলেন। বিজ্ঞপ্তির আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে প্রার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪.২৫ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অথবা সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ন্যূনতম ৩.৫০ পেতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষকদের মধ্যে দুজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৩.৭০ পেয়েছেন। অন্য দুজন স্নাতক সম্মানে সিজিপিএ-৩.৪৫ ও ৩.৪৭ পেয়েছেন। উপস্থিত আটজন প্রার্থীর মধ্যে যে চারজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই আবেদনের শর্ত পূরণ করেন। কিন্তু তাঁদের কেউই নিয়োগ পাননি। একই দিন পরিসংখ্যান বিভাগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত ২ জন নিয়োগ পান। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ পান অতিরিক্ত তিনজন। নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অতিরিক্ত পাঁচজন।
নতুন ইনস্টিটিউট লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে শিক্ষক নিয়োগে আবেদনের শর্ত পূরণ না করলেও দুই প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিসহ আরেকজনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ছিল না। এর বাইরেও যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
১৬ জুন নিয়োগ বোর্ডের সভা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে চারটি পদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাতজনকে নেওয়া হয়। সেখানে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির স্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাতাহাতি করা শিক্ষকদের নিয়োগেও সমস্যা
২০১৫ সালে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আবদুল্লাহ আল মুনীম এবং অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের ইব্রাহিম মিয়া গত ২৯ জুলাই ছাত্র-শিক্ষক হাতাহাতিতে জড়িত ছিলেন। প্রথমজনের নিয়োগে শর্ত ছিল স্নাতকে ন্যূনতম ৩ দশমিক ৭৫ থাকতে হবে, যা তাঁর ছিল না। অন্যজন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে মেধাতালিকায় পেছনের দিকে থাকায় তাঁর ব্যাপারে লিখিতভাবে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছিলেন ওই বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান।
উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের নিজের বিভাগ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও একাধিক সেরা (প্রথম) শিক্ষার্থী বাদ পড়েছেন। ওই সময়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশই ছাত্রদের সঙ্গে হাতাহাতির সময় সেখানে ছিল। যদিও ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যেও এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অগ্রভাগে।

প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও শিক্ষক হতে পারলেন না
২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে একটি স্থায়ী সহকারী অধ্যাপক এবং একটি স্থায়ী প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছয়জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন বিভাগের ১৯তম স্থান অধিকারী হয়েও শিক্ষক হন। তাঁর ‘যোগ্যতা’ ছিল, তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। ওই নিয়োগে বাদ পড়েছিলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া এক প্রার্থী।
এর আগে ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া একাধিক প্রার্থীকে বাদ দিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে যথাক্রমে দশম ও দ্বাদশতম স্থান অধিকারীকে নেওয়া হয়। অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের এক ছাত্রী অভিযোগ করেছিলেন, বিবিএ ও এমবিএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও দুবার সাক্ষাৎকার দিয়েও শিক্ষক হতে পারেননি। তাঁর জায়গায় ষষ্ঠ ও সপ্তম স্থান অধিকারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তাঁকে নেওয়া হয়েছিল। ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষক নিয়োগেও তিনজনের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতির অভিযোগ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ প্রথম আলোকে বলেন, একজন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষ্য থাকবে মেধা। পরে পছন্দ-অপছন্দের বিষয় আসতে পারে। শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। সেখানে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে পড়বে। যাঁদের ন্যূনতম যোগ্যতা নেই, তাঁদের তো নিয়োগ বোর্ডে ডাকাই উচিত হয়নি। আর যেহেতু উচ্চ আদালত বিষয়টি বলেই দিয়েছেন, এখন তো এ বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকে না।