লতুর ধরা পড়বার খবরটা নীলার চিঠিতেই পেয়েছিলাম।
নীলা লিখেছে। ‘তখন রাত বোধ হয় বারোটা হবে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। উত্তরঙ্গ পৃথিবী, রাতের শিশিরে মুখ গুঁজে ঝিমুচ্ছিল ক্লান্তিতে। বড় কাটরা লেনের বাসিন্দাদের চোখে গাঢ় ঘুম নেমেছিল তখন। ঘুম নেবেছিল আমাদের চোখেও। দোরগোড়ায় হঠাৎ ঘা পড়ল। অসহিষ্ণু কড়া নাড়ার শব্দে চোখের পলক জোড়া খুলে গেল আমার। পাশেই শুয়েছিল লতু। পিঠে মৃদু নাড়া দিয়ে জাগালাম ওকে। ‘এই শুনছ! কারা এসে কড়া নাড়ছে। এই শুনছ?’ ‘কে কারা?’ লতুর কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ। গায়ের চাদরটা এক পাশে ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসল সে। পা টিপে টিপে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূর্ত কয়েক নিচের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখল সে। তারপর চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল।
‘চারপাশটা ঘিরে ফেলেছে ওরা।’
‘ওরা কারা?’
‘পুলিশের লোক…।’
নীলার চিঠিখানা পড়ে সেদিন ওর জন্য সত্যি বড় ভাবনা হয়েছিল আমার। একা মেয়ে, দুতিনটা ছেলেপিলে নিয়ে কী করে দিন কাটাবে সে? মা শুনে বলেছিলেন।-‘যেমন কর্ম তেমনি ফল। তখন তো আমাদের কথা ধরেনি। কত বুঝিয়েছিলুম, ঝোঁকের মাথায় কিছু করিসনে বাপু। ও ছেলেটার সাথে বিয়ে হলে ভোগান্তির আর শেষ থাকবে না তোর। পরে, সারাটা জীবন আফসোস করে মরবি। না! কারও কথা শুনল না। ওর বাবা কত ভালো দেখে জামাই ঠিক করেছিলেন ওর জন্য। সে ছেলে এখন করাচিতে মাসে পাঁচ শ টাকা বেতন পায়। কেমন রাজপুত্তুরের মতো ছেলে। কত বুঝিয়েছিলুম, রাজি হলো না মেয়েটা। এখন বুঝবে…।’ বলে মুখ বিকৃত করেছিলেন মা, ক্ষণকাল চুপ থেকে আবার বলেছিলেন। ‘আমি তো আজও ভেবে পাইনে। ওই লতু ছোঁড়াটার কিসে মুগ্ধ হয়ে লীনা ওর সঙ্গে বেরিয়ে গেল। কী আছে ছেলেটার। না রূপ, না অর্থ, কী আছে?’
‘কী আছে লতুর, কিসে মুগ্ধ হলো নীলা?’
—প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছিল বহুবার, নীলাকে জিজ্ঞেস করতে সে শুধু হেসেছিল ঠোঁট টিপে। মুখ খুলে কিছু বলেনি কোনো দিন। আমিও খুব পীড়াপীড়ি করিনি তাকে।
নীলার পুরো নাম ছিল নিলুফার। চোখ দুটো ওর ঘন নীল বলে, আমি ওকে নীলা বলে ডাকতাম। ছোটবেলা, যখন ও ফ্রক পরত, আর আমি হাফপ্যান্ট, তখন এক বাসাতেই থাকতাম আমরা, সিলচরে।
রাতের বেলা বাবা আমাদের দুজনকেই পড়াতে বসতেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে নীলা চটপট উত্তর দিয়ে দিত। আর আমি হাবার মতো চেয়ে থাকতাম। বাবা বলতেন, ‘দে তো মা নীলু, ওর কানটা একটু আচ্ছা করে টেনে দে তো।’
লজ্জা আর ক্ষোভে আমি মাটির সঙ্গে মিশে যেতাম। নীলা মিটিমিটি হাসত। বলো, ‘ওর কানে একটা ফোড়া হয়েছে মামা। টানতে গেলে আমার হাতে পুঁজ লেগে যাবে, আমি পারব না।’
ওর বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হতাম।
তেরো বছর বয়সে, যখন ও ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে, আমি তখন নতুন সিগারেট খাওয়া শিখছি। মা-বাবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে সিগারেট টানতাম। ও দেখলেই ভর্ৎসনা করত। ‘ছি. জাফর ভাই, তোমার এ অধঃপতন। এ অল্প বয়সেই তুমি সিগারেট ধরলে? ওটার গন্ধ শুঁকলেই আমার বমি আসে।’ বলে থু থু করে ও মাটিতে থুতু ছিটাত। ঠোঁট টিপে বলত, ‘দাঁড়াও না আমি মামাকে বলে দেব।’
লক্ষ্মী বোন আমার। একটা লাল ফিতে কিনে এনে দেব তোকে। বাবাকে বলিসনে ও কথা।’
আমার সকরুণ অনুনয়ে ভ্রুক্ষেপ করত না ও। মৃদু হেসে বলত, ‘ঘুষ দিতে চাও বুঝি? তা চলবে না, মামাকে আমি বলবই।’
কিন্তু বলতে ওকে শুনিনি কোনো দিন। সেই নীলা। সত্যি নীলার জন্য বড় ভাবনা হলো।
তখন ছিল ঘনঘোর বরষার মরশুম।
শ্রাবণের এক মেঘলা সকালে ঢাকায় এসে নাবলাম-মহাবিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদগ্র তাড়নায়। আসার আগে নীলাকে একখানা চিঠি পোস্ট করে দিয়েছিলাম, ‘ঢাকায় আসছি, মুসলিম হলে আমার এক বন্ধু থাকে, ওর ওখানেই উঠব। ভর্তির ঝামেলাটা চুকেবুকে গেলে, তোমার সাথে দেখা করতে যাব।’
ঢাকায় নাবতে পরপর সাতটা দিন বৃষ্টি চলল অবিরাম, একমুহূর্তের অবকাশ নেই। কখনো ঝিরঝির বাতাসে ইলশেগুঁড়ির মতো ঝরল বৃষ্টি, কখনো ঝরল তুষারের মতো, কখনো আবার সামুদ্রিক গর্জনে।
বৃষ্টি থামলে পর একদিন সময় করে নীলাকে দেখতে গেলাম। তিনের এক বড়কাটরা লেন। বাইরে কড়া নাড়তে নীলাই এসে দরজাটা খুলে দিল। পরনে একখানা আকাশ রঙের শাড়ি। দুহাতে দুখানা কালো কাচের চুড়ি, মৃদু হেসে নীলা বলল, ‘এতদিনে এলে? এসো, ভেতরে এসো।’ পেছনের কবাটটা ভেজিয়ে দিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল নীলা। মাঝারি গোছের একখানা ঘর। অনাড়ম্বর এক পাশে একটা চওড়া চৌকির ওপর কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা জড়াজড়ি করে ঘুমুচ্ছে। একটা কাঠের টুল এগিয়ে দিয়ে আমায় বসতে বলল নীলা। তারপর একটু নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল। ‘মামা-মামি ওরা ভালো আছেন তো?’
‘হ্যাঁ, ভালো।’
‘রুবি, রাহুল ওরা?’
‘ওরাও ভালো।’
নীলা থামল, এবার আমার প্রশ্ন করার পালা। ‘লতুর কোনো চিঠিপত্র পেয়েছ?’
‘হাঁ, পেয়েছি ।’ হপ্তাখানেক আগে।’
‘এখন কোথায় আছে ও?’
‘ময়মনসিংহ জেলে।’
‘কী লিখেছে?’
‘লিখেছে।…দাঁড়াও চিঠিটা দেখাচ্ছি তোমায়।’ উঠে গিয়ে বিছানার তলা থেকে একটা সাদা খাম বের করে এনে আমার হাতে দিল নীলা। বলল, ‘তুমি পড়ো, এ ফাঁকে আমি দুকাপ চা তৈরি করে আনি।’ চাবিসুদ্ধ আঁচলটা নাড়তে নাড়তে পাকঘরের দিকে চলে গেল নীলা।
লতুর চিঠিটা একবার পড়ে, আর একবার চোখ বুলোচ্ছিলাম। একটু পরে দুকাপ চা নিয়ে আবার এ ঘরে এল নীলা। হাতল ভাঙা, কাপ জোড়া সামনে নাবিয়ে রেখে সলজ্জ কণ্ঠে বলল, ‘হাতল নেই। অসুবিধে হবে না তো তোমার?’
বললাম, ‘বিনয় না দেখালেও চলত, জানো তো, ছোটকালে আমি তামার বাটিতে করে চা খেতাম।’
‘এখন তো আর ছোট নও। বড় হয়েছে।’ নীলা বলল হেসে। চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম।
‘ফুফা সাহেবের কাছ থেকে কোনো চিঠিপত্র পাও না? উনি তো এখন রংপুরে আছেন।’
পেয়ালাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে; এলোমেলো চুলগুলোকে খোঁপাবদ্ধ করতে করতে বলল, ‘ওসব কথা আর জিজ্ঞেস করছ কেন শুধু শুধু। জানো তো। উনি আমায় ত্যাজ্য করেছেন।’ নীলা হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল।
এরপর কী যে বলা যেতে পারে কিছু ভেবে পেলুম না। চুপচাপ কাটল অনেকক্ষণ। নীলা উঠে গিয়ে জানালার শিক ধরে বাইরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাই বলে আমি নাকি ভুল করেছি। ভু-ল।’ ভ্রুজোড়া বিস্তৃত করল নীলা। তারপর আশ্চর্য দৃঢ় কণ্ঠে বলল। ‘ভুল আমি করিনি। না। কক্খনোনা। জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানায় বসল নীলা।
গলাটা একটু খাঁকরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘কিছু করছে টরছ নাকি আজকাল?’
‘না করলে সংসার চলছে কী করে?’ মৃদু হাসল সে। ‘ওর এক বন্ধুর চেষ্টায় চাকরি একটা জুটেছে বিউটি সোপ কোম্পানির এজেন্ট। কাজ তেমন কিছু নয়। তবে ভীষণ ঘোড়াফেরা করতে হয়। বাড়ি বাড়ি ওদের বিভিন্ন স্যাম্পল বয়ে নিয়ে গিয়ে তার গুণাগুণ প্রচার করা।’
‘কত দেয়?’
‘খুব বেশি না । মাসে পঞ্চান্ন টাকা।’ নীলা জবাব দিল।
বললাম, ‘তুমি কাজে গেলে মন্টু, সানু ওদের দেখে কে?’
‘পাশের বাড়িতে আমার এক পাতানো খালা আছে; তার কাছে রেখে যাই। কী আর করবো। ও যত দিন ছাড়া না পাচ্ছে, তত দিন কষ্ট করতে হবে বৈকি।’
সেদিন নীলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোস্টেলে ফিরবার পথে বারবার একটা কথাই ভাবছিলাম, নীলা তো ইচ্ছে করলে সুখে গা ভাসিয়ে দিয়ে দিন কাটাতে পারত। তবু কেন সে দুঃখের পথে পাড়ি জমাল? লতু। লতুর এমন কিই–বা আছে, যা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল তাকে? ভেবেছিলাম, কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাইনি।
এরপর নীলার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো আমার। কখনো রাস্তার মোড়ে। কখনো বাসে। কখনো কখনো ওর বাসায়ও যেতাম আমি। লক্ষ করতাম, দিনে দিনে কেমন যেন ভেঙে পড়ছে নীলা। গায়ের রংটা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যাচ্ছে ওর। দোহারা দেহটা কাঠির মতো শীর্ণ হয়ে আসছে। গাঢ় নীল চোখ জোড়া ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে কোটরে।
ওর স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। বললাম, ‘স্বাস্থ্যের দিকে একটু নজর দাও নীলা। নইলে যে মারা পড়বে।’
শুনে নীলা বলল, ‘ভয় নেই, কমপক্ষে আরো পঞ্চাশ বছর পরমায়ু আছে আমার। সহজে মরব না।’ আলাপ হচ্ছিল নীলার বাসাতেই বসে। তখন পড়ন্ত বিকেল। এক আঁজলা রোদ জানালার ফাঁক দিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ছিল ঘরের মেঝেতে। ক্ষণকাল চুপ থেকে নীলা বলল, ‘একটা ভালো প্রেসের খোঁজ নিয়ে দিতে পারো আমায়? একটু সস্তায় যেখানে কাজ করানো যেতে পারে।’
‘কেন, বলো তো?’ আমার কণ্ঠে বিস্ময়।
হাতের চুড়িগুলো নিয়ে মৃদু নাড়াচাড়া করতে করতে নীলা বলল, ‘কোম্পানিতে আমরা যারা কাজ করি, তারা সবাই মিলে ইউনিয়ন করেছি কি না। তার গঠনতন্ত্রটা ছাপাব।’
‘বেশ বেশ। পলিটিকসে তাহলে তুমিও শেষ পর্যন্ত নাক গলিয়েছ। বেশ বেশ।’ কথাটা কত দূর রূঢ় শুনিয়েছিল জানি না। নীলার মুখটা কঠিন হয়ে এল। অত্যন্ত রুক্ষ গলায় সে জবাব দিল। ‘জানো, নেশায় পড়ে কেউ নাক গলায় না। প্রয়োজনে নাক গলায়। প্রয়োজন।’
শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। কিন্তু তখনো নীলাকে সত্যিকারভাবে জানার অনেক বাকি ছিল। সত্যিকারভাবে তাকে আবিষ্কার করলাম মাস ছ–সাতেক পরে…
সেদিন সকালে খবরে কাগজ পড়তে গিয়ে দেখি লতু ছাড়া পেয়েছে। খবরটা পড়েই আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠছিল মনের মণিকোঠায়। ইচ্ছা হচ্ছিল তখনি ছুটে গিয়ে লতুকে একবার দেখে আসি। কিন্তু ইচ্ছেকে সংযত করতে হয়েছিল নীলার কথা ভেবে। অনেক দিন পর ছাড়া পেল লতু। অন্তত আজ সকালটা নীলা তাকে একান্ত নিরালায় পাক।
নীলাদের বাসার কড়া নাড়তে সানু এসে দরজাটা খুলে দিল। মুখখানা ওর ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য। ভেতরে গিয়ে নীলাকে দেখে ঈষৎ চমকে উঠলাম। মনে হলো যেন একটু আগে প্রবল ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর ওপর দিয়ে। চেহারায় এতটুকু কমনীয়তা নেই। চুলগুলো যেন বিদ্রোহ করেছে, খোঁপার বাঁধনে আর থাকবে না। মিশকালো চোখের মণি দুটোতে যেন ঘনা ঠিকরে পড়ছে কোনো এক অদৃশ্য আততায়ীর উদ্দেশে। দেখে অবাক হলাম। বিস্ময়ের আঁচড় পড়ল কপালে। অনেকটা ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে নীলা, লতু কোথায়?’
মুখ তুলে একপলক তাকাল নীলা। পরক্ষণে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘ওর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছি আমি।’
‘সে-কি’! আমার কণ্ঠরোধ হবার উপক্রম হলো। মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল নীলা। সোলার মতো হালকা দেহটা, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল বার কয়েক। মুখের রুক্ষতায় পলিমাটির আস্তরণ নেবে এল। চোখ জোড়া ধীরে ধীরে ভরে উঠল পানিতে। হঠাৎ বিছানার ওপর উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে উঠল সে।
‘কী হয়েছে নীলা? কী হয়েছে তোমার । কাঁদছে কেন?’
‘এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না আমায়। দোহাই তোমার, এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে নীলা বলল। ‘আমায় একটু হালকা হতে দাও।’
অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদল নীলা। অনেকক্ষণ কাঁদল সে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে গেল।
তখনো আমি ভেবে খেই পাচ্ছিলাম না। এমন কী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যার জন্য লতুকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নীলা? কী ঘটতে পারে?
কী? কেন?
একটু পরেই চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ভেতরে এল নীলা। তারপর কাপড়ের আঁচলে মুখটা মুছে নিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি তো জানো, আত্মীয়–পরিজন সবার মতামত উপেক্ষা করে, সবাইকে শত্রু বানিয়ে আমি ওর সাথে বেরিয়ে এসেছিলাম…।’
‘হ্যাঁ, আমি সব জানি ।’ নীরবে ঘাড় নাড়লাম।
বিছানার ওপর আলতোভাবে বসে নীলা আবার বলল, ‘ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। কত বড় স্বপ্ন আমার! জানো, আমার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা–আকাঙ্ক্ষাকে ও টুকরো টুকরো করে দিয়েছে, ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।’
নীলার চোখজোড়া আবার পানিতে টলমল করে উঠল। কাপড়ের খুঁটে চোখ দুটো মুছে নিয়ে কাঁপা গলায় বলল। ‘তুমি তো জানো, তার জন্য আমি কম লাঞ্ছনা, কম দুঃখ–কষ্ট সইনি। আরও সইতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সে কেন এমন করল? কেন সে এমন করল জাফর ভাই। এর চেয়ে যে মৃত্যুই শ্রেয় ছিল আমার পক্ষে।’ এবার আর কান্নাকে রোধ করতে পারল না নীলা। ডুকরে কেঁদে উঠল সে।
সবকিছু আমার কাছে বড় দুর্বোধ্য বলে মনে হলো। গলার স্বরটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুক্ষ শোনাল আমার। ‘অত ধানাইপানাই না করে, কী হয়েছে ব্যাপারটা খুলে বললেই তো পারো। কী হয়েছে?
‘ও আমার বুকে ছুরি মেরেছে।’ দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল নীলা। ‘জানো জাফর ভাই, কাচকে হিরে বলে ভ্রম করেছিলাম আমি।…জানো, ও একটা কাপুরুষ, আস্ত কাপুরুষ। বন্ড দিয়ে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে।’…বলেই আবার বালিশে মুখ গুঁজল নীলা। সোলার মতো হালকা দেহটা কান্নার দমকে কেঁপে উঠল বার কয়েক।
সূত্র: সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকী, সম্পাদক: আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আজহারুল ইসলাম, ১৩৬০-৬২ সংখ্যা