এ বছর ডেঙ্গুতে ৭১ শিশুর মৃত্যু
রাইদাহ গালিবা রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। গল্প বলা ও লেখায় তার আগ্রহ ছিল। তার লেখা ছোটদের বইও আছে। ইচ্ছা ছিল আর একটু বড় হয়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলে খেলবে। বাধা হয়ে দাঁড়ায় ডেঙ্গু। গত বছরের ৩০ নভেম্বর রাইদাহ গালিবা ডেঙ্গুতে মারা যায়।
সাবেক ব্যাংকার মো. মিজানুর রহমানের একমাত্র মেয়ে রাইদাহ গালিবা। মেয়ের মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, এখনো মেনে নিতে পারছেন না। গত ৯ মাসে মিজানুর রহমানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, রাইদাহ গালিবের মৃত্যু নিয়ে কথা হয়েছে। তিনি জেনেছেন, এ বছরও ভিকারুননিসা স্কুলের তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। তিনি মানতে পারছেন না। বারবার মেয়ের মৃত্যু সামনে চলে আসছে।
গতকাল শনিবার মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য (প্রিভেন্টেবল)। সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর —সবার অবহেলার কারণে এসব মৃত্যু হচ্ছে। এটা কেমন করে মেনে নিই।’
এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে ডেঙ্গুতে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ডেঙ্গু রোগীর জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ওই ওয়ার্ডে শয্যা আছে ৪২টি। কিন্তু গতকাল শনিবার ওই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১০৯টি শিশু ভর্তি ছিল। ডেঙ্গু নিয়ে আসা অর্ধেকের বেশি শিশুকে অন্য রোগে আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
মৃতের ১৮ শতাংশই শিশু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের কম।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ডেঙ্গু রোগীর জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ওই ওয়ার্ডে শয্যা আছে ৪২টি। কিন্তু গতকাল শনিবার ওই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১০৯টি শিশু ভর্তি ছিল। ডেঙ্গু নিয়ে আসা অর্ধেকের বেশি শিশুকে অন্য রোগে আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই হাসপাতালে শিশুদের আনা হচ্ছে। এ পর্যন্ত অন্তত ২৬ জেলা থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে। এই হাসপাতালে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮২ হাজার ৫০৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ভর্তি হয়েছে ৯ হাজার ৫৬ জন। তাদের মধ্যে মেয়ে শিশু ৩১ শতাংশ এবং ছেলে শিশু ৬৯ শতাংশ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮২ হাজার ৫০৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ভর্তি হয়েছে ৯ হাজার ৫৬ জন। তাদের মধ্যে মেয়ে শিশু ৩১ শতাংশ এবং ছেলে শিশু ৬৯ শতাংশ। ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশু আক্রান্ত কম। যদিও মেয়ে শিশুর মৃত্যু বেশি বা প্রায় ছেলে শিশুর সমান। মারা যাওয়া ৭১টি শিশুর মধ্যে ৩৬টি মেয়ে এবং ৩৫টি ছেলে।
ডেঙ্গুতে শিশুদের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকিও তৈরি হলো। এখন শিশুরা একটি ধরনে (ভেরিয়েন্ট) আক্রান্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে তারা অন্য ধরনে আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়বে। শিশুদের আমরা নতুন বিপদে ঠেলে দিলাম।’
শিশুরোগীর চিকিৎসা কিছুটা জটিল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্রোটকল বা চিকিৎসবিধি তৈরি করেছে। তাতে চিকিৎসকদের করণীয় বলা আছে। শিশুরোগবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা বড়দের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ও জটিলও বটে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, একটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে, ডেঙ্গুর কারণে ছোট–বড় সবারই রক্তচাপ কমে যায়। বড়দের রক্তচাপ নিয়ে মানুষ যত মাথা ঘামায়, শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায় না। অনভ্যস্ততার কারণে শিশুদের রক্তচাপ অনেকে ঠিকভাবে মাপতে পারেন না।
অন্য বিষয়টি—শরীরের তরল ব্যবস্থাপনা বা ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, শিশুদের শরীরে ফ্লুইড ব্যবস্থাপনায় খুব সতর্ক থাকতে হয় এবং সারাক্ষণ তা নজরে রাখতে হয়। ফ্লুইড কিছু কম বা বেশি হলে বড়রা ক্ষতি যতটা মানিয়ে নিতে পারেন, শিশুরা তা পারে না।
করণীয় বিষয়ে এই শিশুরোগবিশেষজ্ঞ বলেন, শিশুদের ফ্লুইড ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। দ্বিতীয়ত, শিশুদের উপযোগী ‘ব্লাডপ্রেশার কাপ’ যেন সব জায়গায় পাওয়া যায়, সরকারকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকিও তৈরি হলো। এখন শিশুরা একটি ধরনে (ভেরিয়েন্ট) আক্রান্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে তারা অন্য ধরনে আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়বে। শিশুদের আমরা নতুন বিপদে ঠেলে দিলাম।