রাপা প্লাজা ছাড়তে নোটিশ: ঈদের আগে শঙ্কায় জয়িতার উদ্যোক্তারা

রাজধানীর ধানমন্ডির রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্রছবি: প্রথম আলো

সরকারি ব্র্যান্ড ‘জয়িতা’র নারী উদ্যোক্তাদের রাজধানীর রাপা প্লাজার ফ্লোর ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে ১৪ বছরের পুরোনো এই ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তা ও কর্মীদের মধ্যে। তাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জয়িতার নতুন ভবনে সরাসরি ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ওই বিপণিবিতানের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় অবস্থিত জয়িতার বিপণনকেন্দ্র ও ফুডকোর্ট ২৪ মার্চের মধ্যে খালি করে দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জয়িতার নতুন ভবনে স্টল বরাদ্দ নিয়ে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা করার সুযোগ থাকছে না। সেখানে জয়িতার পুরোনো উদ্যোক্তাদের আবেদন করে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পণ্য বিক্রির সুযোগ নিতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালের নভেম্বরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জয়িতার যাত্রা শুরু হয়। এর ফাউন্ডেশন হয় ২০১৬ সালে। ফাউন্ডেশন দেশজুড়ে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, উদ্যোক্তাদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি, পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রিতে সহায়তা করে।

জয়িতা ফাউন্ডেশনের অধীন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ১২ তলা ‘জয়িতা টাওয়ার’ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জয়িতা টাওয়ার প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত। ধীরগতিতে নির্মাণকাজ শেষে ভবনের উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর।

গত বছরের ডিসেম্বরে ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাপা প্লাজার ওই দুই তলার ভাড়া বজায় থাকবে। ১ এপ্রিল থেকে সেখানে ফাউন্ডেশনের কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হবে না। তলা দুটি রাপা প্লাজা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এর আগে ২৪ মার্চের মধ্যে ফ্লোর দুটি খালি করে দিতে উদ্যোক্তাদের প্রথমে গত ১ জানুয়ারি ও পরে ১৬ জানুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়।

রাপা প্লাজার জয়িতা উদ্যোক্তাদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, রাপা প্লাজায় জয়িতা উদ্যোক্তারা একচেটিয়া ব্যবসা করেছেন। নতুনদেরও এখন সুযোগ দেওয়া উচিত। জয়িতা নিয়ে সরকার বছরের পর বছর গচ্চা দিচ্ছে। এখনো ভাড়া বাবদ ৩৯ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউরের (এসওপি) মাধ্যমে যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের পণ্য নেওয়া হবে। এখানে শুধু সমিতি নয়, এককভাবেও উদ্যোক্তারা পণ্য দিতে পারবেন।

এ ঘটনায় জয়িতার উদ্যোক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ভবনটি নির্মাণের আগে তাঁদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তাঁদের স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় তাঁদের জানানো হয়, নতুন ভবনে তাঁরা সরাসরি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না, শুধু উৎপাদক হিসেবে পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন। সেই পণ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (আড়াই-তিন মাস) বিক্রি না হলে তাঁদের ফেরত দেওয়া হবে।

রাপা প্লাজায় জয়িতার ৯৪টি স্টলের প্রতিটির জন্য উদ্যোক্তারা মাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাড়া দেন। এককভাবে সেখানে কোনো উদ্যোক্তা নয়, সমিতির অধীন স্টল বরাদ্দ নিতে হয়েছে নারীদের।

‘হুট করে দুজনই বেকার হয়ে যাচ্ছি’

গত মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও ফুডকোর্টে গেলে উদ্যোক্তা ও কর্মীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মীম আক্তার নামের এক নারী বিক্রয়কর্মী ১৮ দিনের সন্তান কোলে করে এসেছিলেন। তিনি জানান, চার বছর ধরে তিনি খরা মহিলা সংস্থার বিক্রয়কর্মী ও স্বামী শাকিল হোসেন সাত বছর ধরে ফুডকোর্টের ক্যাশ কাউন্টারে কর্মরত আছেন। দুই বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়।

রাজধানীর রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্রের ভেতরের দৃশ্য
ছবি: প্রথম আলো

মীম বলেন, ‘হুট করে দুজনই বেকার হয়ে যাচ্ছি। এই মাসের পর সন্তান নিয়ে কীভাবে চলব, জানি না।’ শাকিল হোসেন বলেন, ‘কয়েক দিন পর ঈদ, অথচ আমাদের চাকরি চলে যাচ্ছে।’

নীলফামারীর ‘লাকি মহিলা উন্নয়ন সমিতি’–এর হয়ে ২০১৩ সালে স্টল বরাদ্দ পেয়েছিলেন শাহনাজ বেগম। তাঁর স্টলে নারীদের পোশাক ও ঘর সাজানোর পণ্য। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে এখন আমাদের ব্যবসা করার কথা। অথচ এখন আমরা টিকে থাকব কী করে, তা নিয়ে ভাবছি।’

শাহনাজ বেগম আরও বলেন, ‘আমার স্টলের জন্য তৃণমূলে ২০০ নারী কাজ করেন। স্টলে বিক্রয়কর্মী পাঁচজন। আমরা সবাই কর্মহীন হয়ে পড়ব। একেকটি স্টলে ১০–২০ লাখ টাকার মালামাল আছে। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’ দুটি ফ্লোরে কমপক্ষে ৩০০ কর্মী কাজ করেন বলে জানান তিনি।

আমার স্টলের জন্য তৃণমূলে ২০০ নারী কাজ করেন। স্টলে বিক্রয়কর্মী পাঁচজন। আমরা সবাই কর্মহীন হয়ে পড়ব। একেকটি স্টলে ১০–২০ লাখ টাকার মালামাল আছে। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
শাহনাজ বেগম, উদ্যোক্তা

নার্গিস মাসুদ নামের এক প্রবীণ নারী বলেন, ২০০৬ সাল থেকে তিনি উদ্যোক্তা। রাপা প্লাজায় জয়িতার শুরু থেকে তিনি আছেন। জয়িতা শুরুর পর তৃণমূল থেকে আসা কোনো কোনো উদ্যোক্তা গরু বিক্রি করে, ঋণ করে স্টলের বরাদ্দ নিতে জামানতের টাকা সংগ্রহ করেছিলেন, মালামাল কিনেছিলেন।

এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমরা তিলে তিলে জয়িতাকে ব্র্যান্ড করে গড়ে তুলেছি। একদিন নতুন ভবন হবে, সেখানে আমরা যাব, সে রকম স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। এখন ভবন হওয়ার পর আমাদেরই বাদ দেওয়া হচ্ছে।’

রাজনৈতিকভাবে স্টল বরাদ্দ পাওয়া ও দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া ব্যবসা করার কিছু অভিযোগ নাকচ করে কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, কিছু স্টল বরাদ্দ ছিল রাজনৈতিকভাবে। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তারা নিজেরাই চলে গেছেন।

উদ্যোক্তারা কী চাইছেন, জানতে চাইলে বিপণনকেন্দ্রের উদ্যোক্তা জিম্মি আরা জেনি (মফস্বল মহিলা উন্নয়ন সংস্থা) ও ফুডকোর্টের মরিয়ম মান্নান (চুপুরিয়া মহিলা সংস্থা) বলেন, তাঁরা চান, নতুন ভবনে স্টল বরাদ্দ দিয়ে তাঁদের সরাসরি ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ দেওয়া হোক।

রাজধানীর ধানমন্ডির রাপা প্লাজায় জয়িতার ফুডকোর্ট
ছবি: প্রথম আলো

জিম্মি আরা বলেন, নতুন ব্যবস্থাপনায় পণ্য বিক্রির জন্য জয়িতা ফাউন্ডেশন ২০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ কেটে নেবে। আবার পণ্য বিক্রি না হলে ফেরত পাঠাবে। এতে তাঁরা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন।

জয়িতা ফাউন্ডেশনের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রওশন আরা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি ৫ মার্চ বদলি হয়ে গেছেন। তাই জয়িতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।

মন্ত্রণালয় যা বলছে

রাজধানীর ধানমন্ডির রাপা প্লাজায় জয়িতার ফুডকোর্ট
ছবি: প্রথম আলো

জয়িতার নতুন ভবনও ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে অবস্থিত। গত ১৮ মার্চ ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, বড় পরিসরে নান্দনিক নকশায় এটি তৈরি করা হয়েছে। তবে উদ্বোধনের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেখানে বিপণনকেন্দ্র, ফুডকোর্ট, বিউটি পারলার, জিমনেসিয়াম—কিছুই চালু হয়নি। ১২ তলা ভবনের দুটি তলায় শুধু জয়িতা ফাউন্ডেশনের কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পুরো ভবনটি এখনো মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেনি।

রাপা প্লাজার জয়িতা উদ্যোক্তাদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, রাপা প্লাজায় জয়িতা উদ্যোক্তারা একচেটিয়া ব্যবসা করেছেন। নতুনদেরও এখন সুযোগ দেওয়া উচিত। জয়িতা নিয়ে সরকার বছরের পর বছর গচ্চা দিচ্ছে। এখনো ভাড়া বাবদ ৩৯ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউরের (এসওপি) মাধ্যমে যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের পণ্য নেওয়া হবে। এখানে শুধু সমিতি নয়, এককভাবেও উদ্যোক্তারা পণ্য দিতে পারবেন।

জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তানিয়া খান প্রথম আলোকে বলেন, জয়িতার বিষয়ে নতুন করে আবার কাজ শুরু হয়েছে। নতুন ভবনে পণ্য দেওয়ার বিষয়ে অনেক উদ্যোক্তা আবেদন করেছেন। সেখান থেকে আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে। রাপা প্লাজায় যেসব উদ্যোক্তা স্টল দিয়েছিলেন, তাঁরা এখানেও আবেদন করতে পারেন। তাঁদের নেওয়া হবে না, এমন কোনো সিদ্ধান্ত তো নেই।

রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ১২ তলা ‘জয়িতা টাওয়ার’
ছবি: প্রথম আলো

নতুন ভবনে কার্যক্রম আগামী জুনের মধ্যে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জয়িতা ফাউন্ডেশনে এমডি থাকা অবস্থায় বেশ আগেই রাপা প্লাজার দুটি ফ্লোর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোক্তাদের নোটিশ দেওয়া হয়। এটা হুট করে সিদ্ধান্ত হয়নি। নতুন ভবনে কাদের নেওয়া হবে, কাদের নেওয়া হবে না, সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। আগামী সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ সচিব দেশে ফেরার পর জয়িতার উদ্যোক্তাদের বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

এদিকে রাপা প্লাজা থেকে সরে না যেতে উদ্যোক্তারা রিট পিটিশন করেছিলেন এবং ১৮ মার্চ হাইকোর্ট পিটিশনের পক্ষে এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন