বিশ্ব মশা দিবস আজ: সচেতনতায় মিলবে মশাবাহিত রোগ থেকে সুস্থতা
দ্য লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উদ্যোগে ১৯৩০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ আগস্ট মশা দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মশা ও মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা।
দুই মাসের চেয়ে কম আয়ুর এবং মাত্র ২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম ওজনের ক্ষুদ্র প্রাণী মশা। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে, তার প্রায় অর্ধেক (প্রায় ৫২ বিলিয়ন) মারা গেছে মশাবাহিত রোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মশাবাহিত রোগে বিশ্বে বছরে প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার লোক মারা যায়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে মারা যায়। অপর দিকে, সাপ, কুকুর, কুমির, জলহস্তী, সিংহ, নেকড়ে ও হাঙর সম্মিলিতভাবে প্রায় ৭৫ হাজার জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর জন্য যে প্রাণীগুলো দায়ী, তার মধ্যে মশা অন্যতম।
আশ্চর্য হলেও সত্য, ১৯ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা রোগের জীবাণু বহনকারী বা ভেক্টর। প্রথম সাফল্য আসে ১৮৭৭ সালে যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করেন একটি কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ডওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী সময়ে, ১৮৯৪ সালে ম্যানসন ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের সম্ভাব্য ভেক্টর হিসেবে ‘মশাবিষয়ক অধ্যয়ন’ করতে ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের মেডিকেল অফিসার রোনাল্ড রসকে রাজি করান। বছরের পর বছর নিরলস গবেষণা করেন রোনাল্ড রস, তাঁর সহগবেষক ছিলেন ডাক্তার কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রমাণিত হয় অ্যানোফিলিস মশার অন্ত্রের টিস্যুতে ম্যালেরিয়া পরজীবী বহন করতে পারে। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯০২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘নোবেল’ পুরস্কার পান রোনাল্ড। আর ১৯০৩ সালে ব্রিটেনের সম্রাট এডওয়ার্ড স্বর্ণপদকে ভূষিত হন কিশোরীমোহন। তাই রোনাল্ডের আবিষ্কারের দিন, অর্থাৎ ২০ আগস্ট—মশা দিবস হিসেবে বিভিন্ন দেশ নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে, যার মূলে থাকে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ধারণা। দ্য লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উদ্যোগে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, প্রদর্শনী এবং ভিন্নধর্মী আয়োজনে পালিত হয় দিবসটি। এ ছাড়া ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকার মানুষদের ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহও প্রদান করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
সব মশা কি কামড়ায়?
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি মশার প্রজাতি রয়েছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি প্রজাতির মশা মানুষকে কামড়ায়। আর শুধু স্ত্রী-মশা মানুষ বা অন্য প্রাণীদের কামড়ায়; কারণ, ডিম উৎপাদনের জন্য তার রক্তের প্রয়োজন হয়। পুরুষ-মশা গাছের রস, ফুলের মধু প্রভৃতি খায় এবং এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগায়নে সহায়তা করে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা।
মানুষ প্রায়ই যে মশার কারণে নাজেহাল হয়, সেটি ‘কিউলেক্স’ নামে পরিচিত। আপাতদৃষ্টিতে এটি এখনো হয়তো শহরাঞ্চলে কোনো রোগ সৃষ্টি না করলেও, দেশের বিভিন্ন স্থানে গোদ রোগ ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস ছড়াচ্ছে। কিছু অ্যানোফিলিস প্রজাতির স্ত্রী-মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায়। আর ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতি। যার একটি হলো এডিস ইজিপ্টি, আরেকটি হলো অ্যালবোপিকটাস। বাংলাদেশ মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস। ১৯৬৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হলেও সেটিকে তখন ‘ঢাকা ফিভার’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে, তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এ বছর জুলাইতে মশা নিধনে প্রায় ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি ‘মশার কামড় ক্ষতিকর’ নামে স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য একটি বইও প্রকাশ করা হয়েছে।
অপর দিকে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সবার সহযোগিতা এবং সচেতনতার মাধ্যমেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ফলে মিলবে মশাবাহিত রোগ থেকে সুস্থতাও।