দেশের পোশাকশিল্পের সব কারখানার শ্রমিকদের মাসিক হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ছে। টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতাও (নাইট বিল) বাড়বে। সেই সঙ্গে আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যমান নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া ১০ অক্টোবরের মধ্যে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে হবে। এগুলোসহ শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে মালিকপক্ষ।
মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতা, পোশাক কারখানার মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণাটি পড়ে শোনান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
হাজিরা বোনাস ও টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে গত ৩১ আগস্ট থেকে গাজীপুর ও সাভার-আশুলিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে। এ ছাড়া কারখানায় নিয়োগে নারী–পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিতের দাবিতেও বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। আশুলিয়ায় মঙ্গলবারও বন্ধ ছিল ৫৫টি কারখানা।
শ্রম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পোশাকশিল্পের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে চারজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে সভা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের একাধিক দল মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে। পরে শ্রমিকনেতা ও পোশাকশিল্পের মালিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করা হয়। এসব বৈঠকের মাধ্যমে ১৮ দফা দাবি পূরণের সিদ্ধান্ত হয়, যা যৌথ ঘোষণা হিসেবে সবাইকে জানানো হয়েছে।
যে ১৮ দফা দাবি মানা হলো
পোশাকশিল্পের সব কারখানায় শ্রমিকেরা মাসিক হাজিরা বোনাস হিসেবে এখন যা পান, তা থেকে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া রাত আটটার পর বিদ্যমান টিফিন বিলের সঙ্গে বাড়তি ১০ টাকা দেওয়া হবে। আর বিদ্যমান নাইট বিল ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে নাইট বিল ন্যূনতম ১০০ টাকা করা হয়েছে।
বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এখনো এটি সব কারখায় বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। নতুন সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী অক্টোবরের মধ্যে সব কারখানায় সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের তিনজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে অতিরিক্ত সচিবের (শ্রম) নেতৃত্বে একটি কমিটি নিম্নতম মজুরির বিধিবিধান ছয় মাসের মধ্যে পর্যালোচনা করবে। আর ১০ অক্টোবরের মধ্যে কোনো কারখানা শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) বিষয়ে নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ কমিটি বর্তমান মূল্যস্ফিতি বিবেচনা করে শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সক্ষমতা ও করণীয় বিষয়ে আগামী নভেম্বরের মধ্যে একটি সুপারিশ করবে।
# শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস এখন যা পান, তা থেকে ২২৫ টাকা বেশি পাবেন।
# ১০ অক্টোবরের মধ্যে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে হবে।
# আগামী অক্টোবরের মধ্যে সব কারখানায় বিদ্যমান নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে।
# সব কারখানায় ‘ডে-কেয়ার’ সেন্টার স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
# মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন নির্ধারণ।
যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের সার্ভিস বেনিফিট (চাকরি ছাড়ার পর আনুষঙ্গিক আর্থিক সুবিধা) দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আইনের ধারাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের অধিদপ্তরের মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্রমিকদের পক্ষ থেকে রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি ছিল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আপাতত শ্রমঘন এলাকায় টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকেও শ্রমঘন এলাকায় সম্প্রসারিত করা হবে। আর শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী রেশন ব্যবস্থার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে প্রস্তাব করা হবে।
ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, চাঁদাবাজি বন্ধসহ শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনায় এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় তদারক ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের মজুরি আন্দোলনসহ ইতিপূর্বে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক মামলাগুলো পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। পাশাপাশি মজুরির দাবিতে আন্দোলনে নিহত চারজন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে।
এ ছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে সহায়তা করা হবে। এখন পর্যন্ত ২৬ শ্রমিক নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
শ্রমসচিব বলেন, রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আগামী অক্টোবরের মধ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ দেবে এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন
কাজের ধরন অনুযায়ী, নারী-পুরুষের যোগ্যতা অনুযায়ী বৈষম্যহীন নিয়োগ নিশ্চিত করা হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী, সব কারখানায় ‘ডে-কেয়ার’ সেন্টার স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। অন্যায় ও অন্যায্যভাবে শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না।
বর্তমানে শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৬ সপ্তাহ (১১২ দিন)। এখন এটি ১২০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য শ্রম আইন আবার সংশোধনের কার্যক্রম চলমান। সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী ডিসেম্বেরর মধ্যে সংশোধনের কাজটি শেষ করা হবে।
কারখানা সচল রাখার আহ্বান
সচিবালয়ে যৌথ ঘোষণার সময় শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া শ্রমিকদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি দেশের শিল্পকে বাঁচানোর জন্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য ও অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখা এবং সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, বুধবার থেকে প্রতিটি কারখানার কার্যক্রম যাতে চলমান থাকে, শিল্প যাতে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য শ্রমিক, মালিক, সরকার সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, আজ থেকে যদি কোনো পক্ষ কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে, তাহলে সেটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মালিকদের পক্ষে বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকসহ সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, কারখানায় বসেই যেন আলোচনা করেন। কোথাও যেন রাস্তা বন্ধ না হয়, ভাঙচুর না হয়। ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব কুতুব উদ্দিন আহমেদ শ্রমিকদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রমুখ বক্তব্য দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলের হা–মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব, শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার, নাজমা আক্তার, তাসলিমা আখতার, মাহবুবুর রহমান ইসমাইল প্রমুখ।