বিএনপির দণ্ডিত নেতা–কর্মীর সংখ্যা হাজার ছাড়াল
ঢাকার আদালতে চার মামলায় গতকাল ৪৯ জনের সাজা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জামায়াতের নেতা-কর্মীও রয়েছেন।
ঢাকায় আরও চার মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের ৪৯ নেতা-কর্মীর সাজা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত মামলাগুলোর রায় দেন।
বিগত সাড়ে চার মাসে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে এ নিয়ে ৬৭ মামলায় অন্তত ১ হাজার ২৬ নেতা-কর্মীর সাজা হলো। তাঁদের বেশির ভাগ বিএনপি এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। কিছুসংখ্যক জামায়াতের। দণ্ডিতদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নেতা–কর্মী একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
এদিকে দুর্নীতি মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা দ্বিতীয়বারের মতো পিছিয়েছে। গতকাল এই রায় ঘোষণার কথা ছিল। নতুন দিন ঠিক করা হয়েছে ২৮ ডিসেম্বর।
নতুন করে চার মামলায় সাজা
ঢাকার সিএমএম আদালতে গতকাল যে চারটি মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো করা হয় ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে। একটি মামলা ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের। মামলাটিতে ১১ জনকে দুই থেকে ছয় মাস করে সাজা দিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল বিকেলে কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদ এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি মিছিল আসে। তখন বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ২০০ থেকে ৩০০ নেতা-কর্মী মিছিলে হামলা করেন।
ঘটনাটিতে পুলিশের করা মামলায় ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল আদালতে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। আদালত ২০১৫ সালের ২ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পাঁচজন পুলিশ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়।
ঢাকার ডেমরা থানার ২০১২ সালের এক মামলায় গতকাল ২৫ জনকে আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসান। এ মামলায় খালাস পেয়েছেন ১১ জন।
মামলার এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ডেমরার আমুলিয়া সড়কে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের ৪৫ নেতা-কর্মী সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশায় আগুন ধরিয়ে দেন। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যাওয়ার পর তারা রামদা, লাঠি, রড ইত্যাদি নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে।
মামলাটিতে ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ৩৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। পরের বছর ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন করেন আদালত। মামলার ৩০ সাক্ষীর মধ্যে পাঁচ পুলিশ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ।
রায় হওয়া আরেক মামলা রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানার। ২০১৩ সালের এ মামলায় গতকাল ৯ জনকে আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান। তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়।
মামলার এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পল্লবীর হারুন মোল্লা সড়কে জামায়াতের ১২০ থেকে ১৩০ জন নেতা-কর্মী একটি পণ্যবাহী যানে (পিকআপ) আগুন ধরিয়ে দেন। পরে তাঁরা হরতালের সমর্থনে মিছিল করেন এবং সড়কের অন্যান্য যানবাহন ভাঙচুর করেন।
মামলাটিতে ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগ গঠন হয় ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তিন পুলিশ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। আসামিপক্ষ থেকে একজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।
রায় হওয়া চতুর্থ মামলাটি ঢাকার ভাটারা থানায় ২০১৮ সালে দায়ের করা। এতে ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিব চারজনকে তিন বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। খালাস পেয়েছেন ১২ জন।
মামলায় পুলিশ বলেছে, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভাটারার ফাঁসেরটেক এলাকায় রাত সাড়ে আটটায় বিএনপি ও জামায়াতের ৭৫ নেতা-কর্মী গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। খবর পেয়ে
পুলিশ সেখানে যাওয়ার পর ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
মামলাটিতে ২০১৯ সালের ৩১ মে ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ১৫ সাক্ষীর মধ্যে ৪ পুলিশ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়।
‘ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না নেতা-কর্মীরা’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীরা একের পর এক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। বেশির ভাগ মামলায় সাজা হচ্ছে দুই থেকে তিন বছর করে। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় আদালতের রায়ে মামলাগুলোতে ৩৫০ জনের বেশি আসামি খালাসও পেয়েছেন।
মামলাগুলোর বেশির ভাগ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরের ঘটনার এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের। বেশির ভাগ মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও হামলা, যানবাহন ভাঙচুর, আগুন দেওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মামলাজট কমাতেই রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে বিএনপি কোনো লক্ষ্যবস্তু নয়।
সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন যুগ্ম মহাসচিব এবং যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও রয়েছেন। বাকিরা হচ্ছেন বিএনপির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মী। জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও দলের সক্রিয় নেতা-কর্মীরা রয়েছেন।
বিএনপি বলছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করতেই নির্বাচনের আগে তাদের নেতা-কর্মীদের পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করতে তৎপর রাষ্ট্রপক্ষ।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সক্রিয় নেতা-কর্মীদের রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত করতেই এই একের পর এক সাজা। আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না নেতা-কর্মীরা।