দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। আড়াই মাস ধরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেক। আগামী এক মাসেও এলএনজি সরবরাহ বাড়বে না। ফলে শিগগিরই কাটছে না চলমান গ্যাস-সংকট। গ্যাসের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানার উৎপাদন। বিদ্যুৎ-ঘাটতি মেটাতে করতে হচ্ছে লোডশেডিং।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ কোটি ঘনফুট।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে এখন উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা নেওয়া হয় এলএনজি থেকে। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল থেকে ৬০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। আর ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গত ২৭ মে থেকে বন্ধ আছে সামিটের টার্মিনাল। এতে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে দিনে।
টার্মিনাল চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার রাতে সামিটের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাগরের অবস্থা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মাসের শেষ দিকে টার্মিনালের ডিটিএম প্লাগটি পুনঃস্থাপন ও পুনঃসংযোগ দিতে পারবে তারা। এরপর আগামী মাসের মাঝামাঝি এলএনজি সরবরাহ শুরুর জন্য এটি তৈরি হবে।
গ্যাস-সংকটে পড়েছে শিল্প, আবাসিক ও বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ চায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। যদিও তারা সর্বোচ্চ সরবরাহ পেত দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৯০ কোটি ঘনফুট। এতে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। তাই লোডশেডিং হচ্ছে ঢাকার বাইরে।
গ্যাসের সরবরাহ কমায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রান্নার চুলা জ্বালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গ্রাহকেরা। শিল্পকারখানায় আগেই উৎপাদন কমে এসেছিল গ্যাসের অভাবে। এখন কারখানা চালাতে সমস্যা আরও বেড়েছে। গ্যাসের অভাবে বন্ধ আছে তিনটি ইউরিয়া উৎপাদনের সার কারখানা। বছরের বেশির ভাগ সময়ই কোনো না কোনো সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়।
গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, প্রতি মাসে বিল দিলেও গ্যাসের সংকটের কারণে রান্না করতে পারছেন না। নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণ সস্তাপুর এলাকার গৃহিণী মার্জিয়া রহমান বলেন, গ্যাসের চাপ একেবারে নেই। গ্যাস না থাকায় সিলিন্ডারে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। এতে সংসারে খরচ বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গাজীপুরের বেশির ভাগ এলাকায় কয়েক বছর ধরেই গ্যাস-সংকট চলে এলেও দুই মাস ধরে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। নগরের বাসন, ভোগাড় কোনাবাড়ী, ভবানীপুর, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর ও এর আশপাশের এলাকার বেশির ভাগ কারখানায় গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন তাঁদের লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা না হলে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
তিতাসের গাজীপুর শাখা ব্যবস্থাপক (ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন) মো. রেদওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে ৪০ কোটি ঘনফুট।
নারায়ণগঞ্জে বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ এলাকায় অবস্থিত রপ্তানিমুখী টোটাল ফ্যাশন লিমিটেডে প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা ১০ টন। কিন্তু গ্যাস-সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগে কিছু গ্যাস পাওয়া যেত। ৬ আগস্টের পর থেকে গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল, পাইকপাড়া, ভূঁইয়াপাড়া, নয়াপাড়া, শীতলক্ষ্যা, মণ্ডলপাড়া, টানবাজার, গলাচিপা, কলেজ রোড, মাসদাইর, চাঁদমারী, মিশনপাড়া, আমলাপাড়া, ডনচেম্বার, হাজীগঞ্জ, ফতুল্লার কাঠের পুল, দক্ষিণ সস্তাপুর, ইসদাইরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস-সংকট রয়েছে। পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরী, ফতুল্লার শিল্পাঞ্চলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
নিয়মিত অভিযোগ জানিয়েও গ্যাসের সমস্যার কোনো সমাধানে পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। পোশাক খাতের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেক কারখানা উৎপাদন ধরে রাখতে পারছে না। এতে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য রপ্তানি করা কঠিন হয়ে উঠেছে। বাড়তি খরচ করে উড়োজাহাজে বা মূল্যছাড় দিয়ে রপ্তানি পণ্য পাঠানো লাগতে পারে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ]