কারসাজি করে ৫৪০ কোটি টাকার কাজ দলের নেতা–কর্মীদের দিয়েছেন তাপস
নগর ভবনে উন্নয়নকাজের বেচাবিক্রি গত চার বছরে ছিল অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী ও দক্ষিণ সিটির মেয়রের ঘনিষ্ঠজনেরা সংস্থার উন্নয়নকাজ ও বিভিন্ন কেনাকাটার সিংহভাগ কাজ করেছেন। কারসাজি করে কোনো রকমের প্রতিযোগিতা ছাড়াই তাঁরা বাগিয়ে নিয়েছেন এসব কাজ, অঙ্কের হিসাবে যা প্রায় ৫৪০ কোটি টাকা।
এভাবে পছন্দের লোক ও ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে কাজ করানোর ফলে অনেক কাজ যথাসময়ে শেষ হয়নি। এতে মাসের পর মাস জনগণকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আবার গুণগত মান নিশ্চিত করে কাজ করতেও ঠিকাদারকে চাপ প্রয়োগ করা যায়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রকৌশল বিভাগের অন্তত সাতজন কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছে এভাবে কাজ দেওয়া ও বাস্তবায়ন করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে—এ বিবেচনায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তাঁরা।
প্রতিযোগিতা ছাড়াই এত দরপত্রের বিপরীতে কেন একটি করে প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়ে কাজ পেয়েছে, তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কেউ কারসাজি করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।ফারুক হোসেন, বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির সাবেক মহাপরিচালক
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কে কোন কাজ পাবেন, তা আগেই ঠিক করা হতো। সে অনুযায়ী দরপত্র প্রকাশ করার পর নির্দিষ্ট ব্যক্তিই কাজ পেতেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে আরও ১৬৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার কাজ বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি।
বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়নে যেসব কাজ করা হয়েছে, সেসবের দরপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৭৪টি কাজে কোনো প্রতিযোগিতা হয়নি। এর অর্থ, যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল, তখন প্রতিটি কাজের বিপরীতে একটি করেই দরপত্র জমা হয়েছে। এভাবে সংস্থাটি ২০৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার কাজ বাস্তবায়ন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি কাজে একটিমাত্র দরপত্র পড়ার প্রবণতা কমায় অন্তত দুটি করে দরপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় ১২২টি কাজের বিপরীতে দুজন করে ঠিকাদার দরপত্র জমা দিয়েছেন। তবে কে কাজ পাবেন, তা আগে ঠিক করা ছিল। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অপর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দরপত্র জমা দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় ১৭৬ কোটি ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এর বাইরে আরও ১৬৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার আরও ১৩২টি কাজ দলীয় নেতা–কর্মীদের মধ্যে ‘বিতরণ’ করেছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিচালক ও দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন চার কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, নেতা–কর্মীদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে ডেকে নিয়ে কাকে কোন কাজ দিতে হবে, সে নির্দেশনা দেওয়া হতো। অবশ্য নেতা–কর্মীরা বাস্তবায়নের শর্ত পূরণ করতে না পারলে উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো কিছু কাজ। পরে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদারেরা এসব কাজ পেতেন।
২০২০ সালের মে মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। পছন্দের লোক ও দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে কাজ বণ্টন করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে তাঁর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন আগে অনেকটা গোপনে তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
কাগজে–কলমে ঠিক, বাস্তবে উল্টো
দক্ষিণ সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা যথাযথ নিয়ম মেনে ঠিকাদার চূড়ান্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি) অনুসরণ করে কাজ দিয়েছেন। একটি কাজের বিপরীতে একাধিক ঠিকাদার দরপত্র জমা না দিলে তাঁদের কিছুই করার নেই।
দুর্নীতি–অনিয়ম ও টেন্ডারবাজি রোধে ২০১১ সাল থেকে ইজিপির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার চূড়ান্ত করার কাজ শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় যেকোনো দেশ থেকে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, সিটি কর্তৃপক্ষ পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে তাঁকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দিয়ে ইজিপিতে আবেদন করানোর কাজ করে আসছে। প্রক্রিয়াটা দৃশ্যত স্বচ্ছ। কিন্তু শত শত দরপত্রে যখন একটি করে প্রতিষ্ঠান সাড়া দেয় ও তারাই কাজটি পেয়ে যায়, তখন প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদার ও দরপত্র চূড়ান্ত করার কাজ মূলত করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তা তথা মেয়র করেন। তিনি যেহেতু এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাই এ নিয়ে তাঁর কোনো মন্তব্য নেই।
পছন্দের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন
পছন্দের ব্যক্তিদের কাজ দেওয়ায় গত চার বছরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে পুরোনো অনেক ঠিকাদার চলে গেছেন।
মেয়র তাপসের পূর্বসূরি মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময় ৫২ কোটি টাকার কাজ করেছেন—এমন একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের অবস্থান মজবুত করতে পছন্দের লোকদের কাজ দেওয়া শুরু করেছেন—এটা জেনে দক্ষিণ সিটির কাজে আর কোনো দরপত্র জমা দেননি তিনি। যেহেতু কে কাজ করবে, তা আগেই ঠিক করা, তাই দরপত্র জমা দিয়ে টাকা খরচ করতে চাননি।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন আহমদকে একাধিক কাজ দেন। এর মধ্যে মান্নাফিকে দেওয়া গুলিস্তান এলাকায় একটি বহুতল ভবনের দুটি বেজমেন্ট ও একটি আন্ডারগ্রাউন্ডের নির্মাণকাজ এখনো চলছে। এ কাজের জন্য করপোরেশন ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে ৩০ কোটি টাকার একটি কাজ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সিটির একটি বিভাগের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়র আমাকে ডেকে নিয়ে মায়া ভাইকে (মোফাজ্জল হোসেন) ওই কাজ দিতে বলেন। পরে মায়া ভাইকে বলেছি, এ কাজ বিক্রি করে আপনাকে টাকা পাঠিয়ে দেব।’
ওই কর্মকর্তা জানান, পছন্দের লোকদের কাজ দেওয়ার পর তাঁদের সিংহভাগই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে এসব কাজ অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। এ কারণে অপেশাদার অনেকে উন্নয়নকাজে যুক্ত হয়েছেন। পেশাদার ঠিকাদারেরা সিটি করপোরেশন ছেড়ে দিয়েছেন। তাই অনেক কাজে গুণগত মান ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও কাজ ভাগ–বাঁটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ধানমন্ডি লেক সংস্কারের কাজ দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের কামরুল হাসানকে (রিপন)। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আওতাধীন প্রতিটি থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কাজ দিয়েছেন তাপস। কাজ দিয়েছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ সংগঠন দুটির থানা, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদেরও।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলেন, কাগজে–কলমে দলীয় লোকদের কাজ দেওয়া হয়েছে—এটি প্রমাণ করা অসম্ভব। বাস্তবে মেয়র সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে ডেকে কোন কাজ কাকে দিতে হবে, সেই নির্দেশনা দিতেন। পরে ওই ব্যক্তি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঠিক করতেন। মাঠপর্যায়ে ওই ঠিকাদার কাজ করলেও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মেয়রের পছন্দের ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া হতো।
তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে
বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির সাবেক মহাপরিচালক প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কাজ হলে দক্ষিণ সিটিতে একাধিক দরদাতা কাজ পেতে আবেদন করতেন। যেহেতু শতাধিক দরপত্রের বিপরীতে প্রতিটিতে একজন করে দরপত্রদাতা প্রয়োজনীয় নথি জমা দিয়ে কাজ নিয়েছেন, এতে বোঝা যায়, কাজ দিতে কারসাজি করা হয়েছে। প্রতিযোগিতা ছাড়াই এত দরপত্রের বিপরীতে কেন একটি করে প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়ে কাজ পেয়েছে, তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কেউ কারসাজি করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।