২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বেশি দাম দিয়েও চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না কৃষকেরা

ইউরিয়া নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে ৩-৪ ও এমওপি ৯-১১ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটছে।

ইউরিয়া সারের জন্য টাকা জমা দিতে দীর্ঘ লাইনে দঁাড়িয়েছেন কৃষকেরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে বগুড়ার শেরপুরের বেলঘড়িয়া বাজারে
ছবি: সবুজ চৌধুরী

সরকার ইউরিয়া সারের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রতি কেজি ২২ টাকা। তবে সেই সার কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৬ টাকা। অন্যদিকে ১৫ টাকা কেজির এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৬ টাকায়।

এই বাড়তি দাম দিয়েও কোনো কোনো জেলায় চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না কৃষকেরা। সারের জন্য পরিবেশকদের কাছে তাঁদের রীতিমতো ধরনা দিতে হচ্ছে। তারপর যে পরিমাণ সার তাঁরা পাচ্ছেন, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। কোথাও কোথাও কৃষকেরা বিক্ষোভও করছেন।

সারের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবার আমন মৌসুমে বৃষ্টি কম হচ্ছে। বাড়তি দরে ডিজেল কিনে কৃষককে সেচ দিতে হচ্ছে। সরকার ইউরিয়া সারের দামও বাড়িয়েছে। এখন যদি কৃষকদের সার পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, দাম নির্ধারিত দরের বেশি রাখা হয়, তাহলে তাঁরা আমন ধানের পরিচর্যায় নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এতে ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

দেশের সাতটি জেলায় গত দুই দিন সরেজমিন পরিস্থিতি দেখে এবং কৃষকের সঙ্গে কথা বলে সার নিয়ে গতকাল শুক্রবার প্রতিবেদন পাঠান প্রথম আলোপ্রতিবেদকপ্রতিনিধিরা। জেলাগুলো হলো নওগাঁ, যশোর, জামালপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও ও কুষ্টিয়া। প্রতিবেদনগুলোতেই বেশি দাম নেওয়া এবং চাহিদামতো সার না পাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। কোথাও সংকট কম, কোথাও বেশি। কোনো কোনো জেলায় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে চাহিদার বিপরীতে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে এবং সব ধরনের সারের মজুতই গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বেশি। যেমন ইউরিয়া মজুত আছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন, যা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে ২৮ হাজার টন বেশি।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এত দিন বৃষ্টি কম ছিল। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে আমন ধানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা, যা সারের চাহিদা হঠাৎ বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, দেশে সারের সংকট নেই। তবে সরবরাহ বাড়ানো দরকার। সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

দাম বেশি নেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কঠোর মনিটরিং রয়েছে। কেউ বেশি দাম নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অবশ্য কৃষকেরা বলছেন, সারের দোকানে প্রকাশ্যেই বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। রসিদ চাইলে তা দেওয়া হচ্ছে না। দর-কষাকষি করতে গেলে কৃষকদের অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

নির্ধারিত দরে সার নেই

দেশে বছরে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, সাড়ে ৭ লাখ টন টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), সাড়ে ১৬ লাখ টন ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়া ফসফেট) এবং সাড়ে ৮ লাখ টন এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে। ইউরিয়া সার ১০ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি হয়। টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারেরও বড় অংশ আমদানি করা হয়। এমওপির উৎস মূলত বেলারুশ, রাশিয়া ও কানাডা।

সারের উৎপাদন খরচ ও আমদানি মূল্য অনেক বেশি। তবে সরকার পরিবেশক বা ডিলারদের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে সার বিক্রি করে। কোথাও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই।

সাত জেলা থেকে প্রথম আলোপ্রতিবেদকপ্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, ৫০ কেজির এক বস্তা ইউরিয়া সারের সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১ হাজার ১০০ টাকা, যা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। আর ৭৫০ টাকার এমওপি সার কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। কোথাও কোথাও দাম আরও বেশি।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বরিয়া গ্রামের কৃষক আতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগে তিনি ২৫ টাকা কেজি দরে ৫০ কেজি ইউরিয়া সার কিনেছেন। বেশি দাম দিতে হয়েছে, তারপরও তিনি কিনেছেন ধানখেতে সার দেওয়া জরুরি বলে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দোকানে গিলি পারে বলে, নিলে নেও, না নিলে যাও। কে দেগবি এসব।’

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দনগর ইউনিয়নের গণেশপাড়া গ্রামের কৃষক ও স্কুলশিক্ষক আবদুল মোতালেব গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ছাতড়া বাজারে যান ইউরিয়া ও এমওপি সার কিনতে। তিনি বলেন, তাঁর কমপক্ষে চার বস্তা ইউরিয়া ও দুই বস্তা এমওপি সার প্রয়োজন। ডিলারের কাছে গিয়ে দুই বস্তা ইউরিয়া ও এক বস্তা এমওপি সার পেয়েছেন। প্রতি বস্তা ইউরিয়ার দাম নিয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর এক বস্তা এমওপি কিনেছেন ১ হাজার ৪০০ টাকায়।

দাম বেশি নেওয়ার ক্ষেত্রে বিক্রেতাদের দাবি হলো, পরিবহন ব্যয় অনেকটা বেড়ে গেছে। আবার কৃষকেরা বাকিতে সার কেনেন। ধান বিক্রি করে দাম দেন। সব মিলিয়ে কিছুটা বাড়তি দাম নেওয়া হয়।

অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামের বেশি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো কোনো জেলার কৃষি কর্মকর্তারা বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকারও করেন।

জামালপুরে ডিএইর উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দাম বেশি নিচ্ছেন। তবে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা রসিদ ছাড়া সার বিক্রি করছেন। তারপরও তাঁদের ধরতে চেষ্টা করা হচ্ছে।

দোকানে ভিড়, বিক্ষোভ

সার না পেয়ে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দেড় শতাধিক কৃষক গতকাল দুপুরে উপজেলার কাহারোল সেতুর ওপর প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনিরুল হাসান সারের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। গতকাল বিকেলেই উপজেলায় ইউএনওর উপস্থিতিতে সার বিতরণ করা হয়।

কাহারোল উপজেলার মুকুন্দপুর পানিশাইল গ্রামের কৃষক জাকিরুল ইসলাম বলেন, তিনি এমওপি সারের জন্য পাঁচ দিন ধরে ঘুরছিলেন।

এর আগে গত বুধবার বগুড়ার ধুনট উপজেলার কৃষকেরা চাহিদা অনুযায়ী সার না পেয়ে ধুনট-বগুড়া বাইপাস সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কৃষকেরা যেখানে সার আছে বলে জানতে পারছেন, সেখানে গিয়ে কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। উপজেলার কুসুম্বি ইউনিয়নের বেলঘরিয়া বাজারে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার দেখা যায়, সার বিক্রির ক্ষেত্রে উত্তেজনা ঠেকাতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

সারের সংকট রয়েছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায়ও। গতকাল বেলা তিনটায় শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের জমাদারপুকুর বাজারের বিসিআইসির সার ডিলার রোজ এন্টারপ্রাইজের গুদামের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সার কিনতে যাওয়া কৃষকদের ভিড়। উপজেলার জামুন্না গ্রামের আমনচাষি ফুল মাহমুদ (৫৫) বলেন, তিনি ১০ বিঘা জমিতে ১৫ দিন আগে আমনের চারা রোপণ করেছেন। এখন পাঁচ বস্তা ইউরিয়া কেনা জরুরি। তিনি বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে সারের জন্যি এ বাজার থেকে ও বাজারে ঘুরিচ্চি। সার মিলাবার পারিচ্চি না। আমনত সার দিবার না পারলে ফসল হবি না, না খ্যায়া থাকা লাগবি।’

বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়

সরকার ১ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ায়। এরপর ৫ আগস্ট বাড়ানো হয় ডিজেলের দাম। লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১১৪ টাকা। কৃষকেরা বলছেন, এতে তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়তে পারে চলতি আমন মৌসুমে। দেশে বছরে যে সাড়ে তিন কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন ওঠে আমনে। এ মৌসুমে ফলন ভালো না হলে চাল আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। দামও বাড়বে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, আমনে ঘাটতি হবেই। ঘাটতি কী মাত্রায় হবে, সেটি খণ্ড খণ্ডভাবে না দেখে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। চালের দামের মাধ্যমে এই ঘাটতির প্রভাব বেশি পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর। তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্তরা দু-তিন লাইনের বিবৃতি দিয়েই কাজ শেষ করছেন।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়াবগুড়া; প্রতিনিধি, যশোর, নওগাঁ, জামালপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওশেরপুর, বগুড়া]