ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে, এডিস মশার বর্ষা জরিপও হলো না

ডেঙ্গু মশাপ্রতীকী ছবি

ডেঙ্গুতে আগস্টে মৃত্যু হয় ২৭ জনের। আর চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) ১২ দিন বাকি থাকতেই এডিস মশাবাহিত এ রোগে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু বাড়ছেই। গতকালও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে; কিন্তু বর্ষা মৌসুম পার হয়ে যাওয়ার পরও এবার ডেঙ্গুর বর্ষাকালীন জরিপ হয়নি। বর্ষা–পরবর্তী জরিপ নিয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো তৎপরতা নেই।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি বুঝতে প্রতিবছর তিন দফায় এডিস মশার জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য এ জরিপ খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছর শুধু এপ্রিল মাসে বর্ষা-পূর্ব জরিপটি হয়েছিল।

সামনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে বলেই মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা। তাঁরা বলছেন, মশার লার্ভার উপস্থিতি কোথায় কতটা, সে বিষয়ে কারও হাতে কোনো তথ্য নেই। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে তা সামলানো কঠিন হতে পারে।

জরিপ অনুযায়ী, উত্তর সিটির অবস্থা আগের বছরের চেয়ে ভালো হলেও দক্ষিণের পরিস্থিতি গত বছরের মতোই ছিল। গত বছর ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়।

চলতি বছরের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও মার্চ মাস থেকে এ প্রবণতা কমে আসে। তবে আগস্ট মাসের শেষ দিক থেকে তা বাড়তে থাকে। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ২৩৮ জন। আর আগস্ট মাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫২১।

আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটেছে। এ কারণে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।

ডেঙ্গুর পরিস্থিতির আগাম ধারণা নিতে এডিস মশার জরিপ হয় ফি বছর তিনবার—বর্ষার আগে, বর্ষার সময় ও পরে। এডিস মশার ঘনত্ব দেখে আগাম ধারণা পাওয়া যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ কতটুকু হবে। এসব জরিপ হয় মূলত ঢাকার দুই সিটিসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে। তবে একাধিকবার দেশব্যাপী জরিপও হয়েছে। এ বছর সর্বশেষ বর্ষা–পূর্ব লার্ভা জরিপ হয় এপ্রিল মাসে। জরিপ অনুযায়ী, উত্তর সিটির অবস্থা আগের বছরের চেয়ে ভালো হলেও দক্ষিণের পরিস্থিতি গত বছরের মতোই ছিল। গত বছর ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়।

তিনবার জরিপের ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের প্রভাব বোঝাটা সহজ হয়ে উঠেছিল। আগাম প্রস্তুতি নেওয়ারও সুযোগ ছিল; কিন্তু এবার বর্ষাকালে জরিপই হলো না। আমাদের হাতে কোনো উপাত্ত নেই যে এর নিয়ন্ত্রণে কী করতে হবে।
অধ্যাপক বে-নজির আহমদ

জরিপ এবার হলো না কেন

দেশে প্রতিবছর এডিস মশার জরিপ শুরু হয় ২০১৩ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার তৎকালীন পরিচালক বে-নজির আহমদের নেতৃত্বেই এটি শুরু হয়। তবে তখন জরিপ হতো একবারই, বর্ষা–পূর্ব সময়ে।

২০১৯ সাল থেকে বছরে তিনবার জরিপ শুরু হয় বলে জানান অধ্যাপক বে-নজির আহমদ। তিনি গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনবার জরিপের ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের প্রভাব বোঝাটা সহজ হয়ে উঠেছিল। আগাম প্রস্তুতি নেওয়ারও সুযোগ ছিল; কিন্তু এবার বর্ষাকালে জরিপই হলো না। আমাদের হাতে কোনো উপাত্ত নেই যে এর নিয়ন্ত্রণে কী করতে হবে।’

ডেঙ্গু ছাড়াও ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস বি ও সি, কালাজ্বরসহ নানা রোগের জরিপ ও নিরাময়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি)’ নেয়। এটি একধরনের কর্মসূচি। এর আওতায় এডিস মশার জরিপ হয়। সর্বশেষ পাঁচ বছর মেয়াদি ওপি শুরু হয় ২০১৭ সালে। এটি শেষ হয় ২০২২ সালে। এর পরের দুই বছর আগের ওপিকেই এগিয়ে নেওয়া হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় চলতি বছরের জুন মাসে। এরপর নতুন করে ওপির জন্য একাধিক সভা এবং পরিকল্পনাও হয়; কিন্তু জুলাই মাসে শুরু হওয়া আন্দোলনের কারণে আর ওপি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর এতে অন্তর্ভুক্ত ডেঙ্গুর জরিপও হয়নি।

ডেঙ্গুর জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জরিপের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। এর জন্য অর্থের সংস্থান বা পরিকল্পনা তো মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে। বর্ষার জরিপের জন্য যেমন কোনো তাগাদা দেওয়া হয়নি। পরবর্তী জরিপের জন্যও এখন পর্যন্ত তাগাদা নেই।’

এডিসের প্রকোপ বাড়ছে, মোকাবিলার দিকনির্দেশনা নেই

ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক জরিপে দেখা যায়, আগস্ট মাসের তুলনায় ঢাকার দুই সিটিতে চলতি মাসে এডিসের বংশবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। দুই সিটির ব্রুটো ইনডেক্সও (লার্ভা বা শূককীটের ঘনত্ব) আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে বেড়েছে; কিন্তু আসলে ঢাকা বা বাইরে এডিস মশার ঘনত্ব আসলে কত তা বোঝার উপায় নেই, কারণ কোনো জরিপ নেই।

আমরা জরিপের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। এর জন্য অর্থের সংস্থান বা পরিকল্পনা তো মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে। বর্ষার জরিপের জন্য যেমন কোনো তাগাদা দেওয়া হয়নি। পরবর্তী জরিপের জন্যও এখন পর্যন্ত তাগাদা নেই।
ডেঙ্গুর জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান

জুলাই ও আগস্ট মাসে আন্দোলনের সময় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আগস্টের ৫ তারিখে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার কয়েকটি ওয়ার্ড কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। এ সময় মশা নিধনের সামগ্রী এবং কোথাও কোথাও ওষুধও নষ্ট করে ফেলা হয়। এসব ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়। এটি জনস্বাস্থ্যের জটিল বিষয়। এর সঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নগর ব্যবস্থাপনা, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি বিষয় জড়িত। এটি বুঝতে পারলে জরিপের মতো বিষয়কে পাশ কাটানো যেত না।’

বর্ষাকালে সাধারণত এডিসের বিস্তার ঘটে এবং ডেঙ্গু ছড়ায়। তবে ২০২২ সালে অক্টোবর মাসে দেশে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনগুলোর নিজস্ব তাগিদে জরিপের তাগিদ দেন।

ডেঙ্গু শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়। এটি জনস্বাস্থ্যের জটিল বিষয়। এর সঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নগর ব্যবস্থাপনা, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি বিষয় জড়িত। এটি বুঝতে পারলে জরিপের মতো বিষয়কে পাশ কাটানো যেত না।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন