ঢাকায় এবার জিকা রোগী শনাক্ত

জিকা ভাইরাস পরীক্ষাপ্রতীকী ছবি: রয়টার্স
  • জিকা দেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে।

  • আইইডিসিআর জানিয়েছে, জিকার কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, এর চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক।

  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরল–জাতীয় খাবার খেতে হবে, জ্বর ও ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে হবে।

  • রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কাছের সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে বা রোগীকে ভর্তি করতে হবে।

ঢাকায় এবার জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত তিন মাসে আটজনের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি জানা গেছে। গত বছরও পাঁচজন জিকা রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসার পর তাঁরা এখন ঝুঁকিমুক্ত। আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এডিস মশাবাহিত জিকা রোগ দেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) সংরক্ষিত রক্তের নমুনা পরীক্ষায় তা জানা যায়। জিকায় আক্রান্ত ওই রোগী ছিলেন চট্টগ্রামের। ২০১৭ সালে আইইডিসিআরের একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের মাধ্যমে বিষয়টি প্রথম জানা যায়।

গত বছর পাঁচজন জিকা রোগী শনাক্ত করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা তখন প্রকাশ করেনি। সতর্কতামূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি চিকিৎসার বাড়তি কোনো ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

গবেষকেরা বলছেন, জিকার পাশাপাশি ঢাকা শহরে এখন চিকুনগুনিয়ায় অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এর অর্থ, ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া—এই তিন রোগে ঢাকা শহরের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগ তিনটি ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। গতকালও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় এক হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। মারা গেছেন ১০ জন। ঢাকা শহরের বাইরের ডেঙ্গুর তথ্য থাকলেও জিকা ও চিকুনগুনিয়ার পরিস্থিতি কী, তা জানার কোনো ব্যবস্থা নেই।

সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জিকা শনাক্ত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বড় ধরনের সতর্কসংকেত। চিকিৎসা ও প্রতিরোধ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে।

জিকার বিষয়ে আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বাকি ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ায় লালচে দানার মতো ছোপ (র‌্যাশ) দেখা দেয়। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ লালচে হওয়া, মাংসপেশি ও গিঁটে ব্যথা থাকে। আক্রান্ত হওয়ার ৩ থেকে ১২ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়, থাকে ২ থেকে ৭ দিন।

আইইডিসিআর জানিয়েছে, জিকার কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, এর চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরল–জাতীয় খাবার খেতে হবে, জ্বর ও ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে হবে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কাছের সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে বা রোগীকে ভর্তি করাতে হবে।

ঢাকায় জিকা

আইইডিসিআরের গবেষকেরা ডেঙ্গু রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষার সময় জিকা ভাইরাস শনাক্ত করেছেন। অন্তত চারজনের নমুনা পরীক্ষায় জিকা শনাক্ত হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, গত দেড়–দুই মাসের নমুনা পরীক্ষায় জিকা শনাক্ত হয়েছে। জিকা শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিরা রাজধানীর ধানমন্ডি, শ্যামলী ও বনানীর বাসিন্দা। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে পাওয়া মশার নমুনাতেও জিকা ভাইরাস পাওয়া গেছে।

গত আড়াই মাসে আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের গবেষকেরাও তাঁদের গবেষণাগারে নমুনা পরীক্ষায় জিকা রোগী শনাক্ত করেছেন। অন্তত চারজনের রক্তের নমুনা পরীক্ষায় জিকা শনাক্ত হয়েছে। তাঁরা আইসিডিআরবির এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করেন।

এর অর্থ হচ্ছে, আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা গত তিন মাসে আটজনের জিকায় সংক্রমিত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। ঢাকার বাইরে কী পরিস্থিতি তা জানা নেই। কারণ, ঢাকার বাইরের নমুনা আইসিডিডিআরবি বা আইইডিসিআর পরীক্ষা করেনি।

জিকা ভাইরাসজনিত রোগ। গর্ভবতী মা জিকায় সংক্রমিত হলে গর্ভের সন্তানের ‘মাইক্রোসেফালি’র ঝুঁকি থাকে। অর্থাৎ মাথা ছোট হয়। বয়স্ক মানুষেরা আক্রান্ত হলে তার গুলেনবারি সিনড্রোমের (জিবিএস) আশঙ্কা থাকে। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এই ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়।

জিকার দুটি ধরন আছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। একটি আফ্রিকান, অন্যটি এশিয়ান। আইসিডিডিআরবি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় তাঁদের পাওয়া জিকা ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, ধরনটি এশিয়ান।

জিকার ঘটনা প্রকাশ করা হয়নি

দেশের মানুষ জিকায় আক্রান্ত হচ্ছেন, এটি জানত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষার সময় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা পাঁচজনের নমুনায় জিকার উপস্থিতি পান। বিষয়টি তাঁরা এ বছর ফেব্রুয়ারিতে লিখিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখায় পাঠান।

তখন রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম। গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ওই শাখার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইসিডিডিআরবি থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল; কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কিছু করা হয়নি। মানুষের ভেতরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন অনুমান থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে এগোতে চাননি।’

জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের ব্যাপারে মানুষকে জানানো ও সজাগ করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ। একই সঙ্গে নতুন রোগের বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াও তাদের কাজ। এ ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি।

আছে চিকুনগুনিয়া

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন জানিয়েছেন, এ বছর বেশ কয়েকজন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। অন্যদিকে আইসিডিডিআরবির পরীক্ষাগারে এক মাসে ২৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে।

রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক হালিমুর রশিদ কিছু দিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা যেন ঠিকমতো হয়, আমাদের মনোযোগ সেই দিকে।’