পদ্মফুলের ডাঁটা থেকে তৈরি সুতায় বোনা পদ্মরেশম

নিজের বোনা পদ্মরেশম কাপড় হাতে আছিয়া বেগম
ছবি: সংগৃহীত

এককালে ঢাকাই মসলিনের নামডাক ছিল বিশ্বজুড়ে। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে সুতা বানিয়ে বয়ন করা হতো অতিসূক্ষ্ম কাপড় মসলিন। একসময় মসলিনের বুনন বিলুপ্ত হয়ে যায়। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী সেই কাপড় বোনার অনন্য শিল্পকর্ম।

বছর কয়েক আগে ঢাকাই সেই মসলিনের পুনর্জন্ম হয়েছে। আমাদের দেশেরই কয়েকজন কারিগর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। সেই কারিগরি দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এবার পদ্মফুলের ডাঁটা থেকে তৈরি সুতায় বানানো হয়েছে বিশেষ একটি স্কার্ফ, যা পদ্মরেশম বা লোটাস সিল্ক নামে পরিচিত।

পদ্মরেশম সুতার রং হালকা দুধে–হলুদ। পদ্মফুলের ডাঁটায় থাকা একধরনের আঠা থেকে তৈরি হয় এই সুতা। সেই সুতায় তৈরি সিল্ককে বলে লোটাস সিল্ক। সারা বিশ্বে এই লোটাস সিল্ক অনেক দামি কাপড়। এক কেজি পদ্মরেশম সুতার দাম ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ ডলার (৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা)। আর প্রতি গজ কাপড়ের দাম পড়ে ২৫ থেকে ১ হাজার ডলার পর্যন্ত। পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় লোটাস সিল্কের উৎপাদন ও ব্যবহার বহু পুরোনো। আমাদের দেশে লোটাস সিল্কের ব্যবহার নতুন।

গর্ততাঁতে জামদানি বয়নকৌশল অবলম্বনে সম্প্রতি ছয় গজ দীর্ঘ স্কার্ফটি বোনা হয়। পরে এটি ইউনেসকোকে দেওয়া হয়েছে। স্কার্ফটি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের কার্যালয়ে রাখা আছে। যে কেউ চাইলে স্ফার্ফটি দেখে আসতে পারেন। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পদ্মরেশম সফলভাবে তৈরি করতে পারায় আমাদের বস্ত্রবয়নশিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশে অনেক পদ্মবিল রয়েছে। এসব বিলে সারা বছরই পানি থাকে এবং যেকোনো সময় চাইলে পদ্মফুলের ডাঁটা সংগ্রহ করা যায়।

আশার কথা শোনালেন পদ্ম–গবেষক ও বেঙ্গল প্ল্যান্টস রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিপিআরডি) চেয়ারম্যান শিকদার আবুল কাশেম শামসুদ্দীন। তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে মজুরি কম হওয়ায় সুতা কাটা এবং কাপড় উৎপাদনের ব্যয় কম হবে। ফলে আমাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করাও সহজ হবে।’

পরিবেশবান্ধব সুতা

পদ্মফুলের ডাঁটা থেকে সুতা কাটছেন ফরিদপুরের নারীরা
ছবি: সংগৃহীত

পদ্মের ডাঁটায় থাকে অসংখ্য ছোট ছোট কূপ বা পোর। সেখানে জমে থাকে আঠাসদৃশ পদার্থ। এই আঠা বাতাসের সংস্পর্শে এসে জমাট বেঁধে যায়। সেটি নৈপুণ্যের সঙ্গে পাকিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। এই সুতা বাতাসে দ্রুতই শুকিয়ে যায়। রোদে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই সুতা থেকেই কাপড় তৈরি হয়।

গোলাপি পদ্মের (Nelambo Nucifera) ডাঁটা পদ্মরেশম সুতা তৈরির জন্য আদর্শ। অন্য পদ্ম থেকেও সুতা তৈরি হতে পারে। সুতি সুতা ও মালবেরি সিল্ক সুতার চেয়ে এই সুতা শক্ত, টেকসই ও শতভাগ পানিরোধী। তবে অধিক প্রসারণযোগ্য না হলেও এই সুতা কোঁচকায় না। এই সুতা প্রাকৃতিকভাবে উজ্জ্বল, কোমল ও বায়ু চলাচলকারী। এতে চমৎকার রং ধরে এবং যেকোনো রং করলেই তা আরও সুন্দর হয়।

এই সুতা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হয়। এর উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় কীটপতঙ্গের প্রাণহানি হয় না। অন্য যেকোনো সিল্ক সুতার চেয়ে পদ্মরেশম সুতা কাটা সহজ ও পরিবেশবান্ধব। এই সুতা উৎপাদনে পানির প্রয়োজন হয় না এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার না হওয়ায় কার্বন নিঃসরণও হয় না।

গোলাপি পদ্মের (Nelambo Nucifera) ডাঁটা পদ্মরেশম সুতা তৈরির জন্য আদর্শ। অন্য পদ্ম থেকেও সুতা তৈরি হতে পারে। সুতি সুতা ও মালবেরি সিল্ক সুতার চেয়ে এই সুতা শক্ত, টেকসই ও শতভাগ পানিরোধী। তবে অধিক প্রসারণযোগ্য না হলেও এই সুতা কোঁচকায় না।

পদ্মের নানা ব্যবহার

গোলাপি পদ্ম হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র ফুল হিসেবে সমাদৃত। পদ্মের বড় গুণ—এটি পানি পরিষ্কার রাখে। অর্থাৎ এটি ন্যাচারাল ওয়াটার পিউরিফায়ার। ভেষজ গুণসম্পন্ন পদ্মফুলের মধুর সুনাম জগৎজোড়া। এর পুংকেশর দামি ভেষজ চা হিসেবে সেবন করা হয়। পদ্মের ডাঁটা ও কচিপাতা রান্না করে খাওয়া যায়। খাওয়া যায় এর শিকড়ও। এই কন্দ কার্বোহাইড্রেটের ভালো উৎস। ঔষধি গুণের কারণে পদ্ম বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। সাদা পদ্মের পাপড়ি থেকে সুগন্ধি তৈরি হয়। চীন ও ভারত ছাড়াও জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াসহ প্রাচ্যের নানা দেশে আছে পদ্মের নানা রকম ব্যবহার।

আমাদের দেশে পদ্মরেশম বা লোটাস সিল্ক নতুন হলেও পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় এর উৎপাদনের আছে দীর্ঘ ইতিহাস।

পুংকেশর দামি ভেষজ চা হিসেবে সেবন করা হয়। পদ্মের ডাঁটা ও কচিপাতা রান্না করে খাওয়া যায়। খাওয়া যায় এর শিকড়ও।

দেশে সম্ভাবনা

দেশের বিভিন্ন জেলায় অন্তত ৩৫-৪০টি পদ্মবিল আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিলগুলো সরকারি মালিকানাধীন। এসব বিলে সারা বছর পানি থাকে এবং পদ্ম সংগ্রহ করা যায়।

পদ্মের ডাঁটা কেটে নিলে পানির নিচে আবার বাড়তে থাকে। এই বৃদ্ধি প্রতিদিন অন্তত ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি। ফলে প্রতি মাসে কম করে হলেও পাঁচবার পদ্মের ডাঁটা সংগ্রহ করা সম্ভব। ডাঁটা সংগ্রহ থেকে শুরু করে কাপড় তৈরি পর্যন্ত এক মাস পর্যন্ত সময় লাগে বলে জানিয়েছেন পদ্ম–গবেষক শিকদার আবুল কাশেম শামসুদ্দীন।

সাধারণ পদ্মের এক-দুটি ডাঁটা নিয়ে এক ইঞ্চি পরপর ভাঙার পর যে আঠা নির্গত হয়, সেটি পাকিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। তবে এই ডাঁটার সংখ্যা বেশি হলে সুতা মোটা হবে। আর ডাঁটার সংখ্যা কম হলে সুতা সরু হবে। এই আঠার বৈশিষ্ট্য অনেকটা ফুটি কার্পাস তুলার মতো বলে আমাদের দেশের নারীরা সহজেই উন্নতমানের সুতা কাটতে পারেন। আর সেটি প্রমাণও করেছেন ফরিদপুরের কানাইপুরের রনকাইল গ্রামের নারীরা। মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণেই তাঁরা চমৎকার সুতা কাটতে সক্ষম হয়েছেন। মাস ছয়েক আগে এই নারীরা সরু সুতা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশে সাধারণত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর সুতা কাটার ভালো সময়। পদ্মফুলও এ সময় ভালো পাওয়া যায়। এই সিল্ক উৎপাদন কৃষির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় গ্রামীণ নারীদের জন্য আয়ের নতুন উৎস হতে পারে। এ জন্য এই প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর দক্ষ কাটুনি তৈরি হবে এবং তাঁরা এই কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন।

কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে পদ্মফুলের প্রায় ৩০ হাজার ডাঁটা দিয়ে এক কেজি সুতা তৈরি হয়। আমাদের দেশে মাত্র ১৫ হাজার ডাঁটা দিয়ে ওই পরিমাণ সুতা তৈরি সম্ভব বলে জানান তাঁত বোর্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন বিভাগের প্রধান মো. আইয়ুব আলী।

সাধারণ পদ্মের এক-দুটি ডাঁটা নিয়ে এক ইঞ্চি পরপর ভাঙার পর যে আঠা নির্গত হয়, সেটি পাকিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। তবে এই ডাঁটার সংখ্যা বেশি হলে সুতা মোটা হবে। আর ডাঁটার সংখ্যা কম হলে সুতা সরু হবে।

নেপথ্যে যাঁরা

স্কার্ফটি তৈরির লক্ষ্যে ‘পদ্মফুলের বৈচিত্র্য, ব্যবহার উপযোগিতা ও সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্প নেয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিপিআরডি। যার পরামর্শক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রাখহরি সরকার। এ ছাড়া সুতা কাটা, রং করা ও কাপড় বোনায় সহায়তা করেছেন তাঁত বোর্ডের ব্যবস্থাপক (অপারেশনস) মো. মঞ্জুরুল ইসলাম। তাঁদের সহায়তা করেছেন মসলিন প্রকল্পের সহায়তাকারী মো. মোহাইমিনুল ইসলাম। সুতা থেকে কাপড় বুনেছেন সোনারগাঁর ওস্তাদ কারিগর আছিয়া বেগম।

এই প্রকল্পে নানাভাবে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মো. তাজউদ্দিন। গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে।

চাই যথাযথ পরিকল্পনা

পাইলট প্রকল্পের অভিজ্ঞতার নিরিখে মো. আইয়ুব আলী মনে করেন, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হলে সুতা তৈরিতে অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম পদ্মের ডাঁটা প্রয়োজন হবে এবং মিহি সুতা কাটাও সম্ভব হবে। এ ছাড়া কাপড়ের উৎপাদন বেশি বাড়াতে জ্যাকার্ড ও আধা স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিশ্লেষক ও গবেষকেরা বলছেন, নতুন সম্ভাবনার পদ্মরেশম বাংলাদেশের জন্য হতে পারে ‘তুরুপের তাস’। যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক বাস্তবায়ন বিশ্বের বিলাসী পোশাকের বাজারে পদ্মরেশম দিয়ে বাংলাদেশ ভিন্ন জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে।