সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
বিকৃত ভিডিও–টিভি সিরিজ দেখে অপরাধের কৌশল শিখছে কিশোর–তরুণেরা
চট্টগ্রাম নগরে আলিনা ইসলাম আয়াত নামের পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে অপহরণের পর ছয় টুকরা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আলিনাদের বাসার ভাড়াটে আবির মিয়া নামের এক তরুণকে। যাঁকে চাচ্চু ডাকত আলিনা। গত মাসে জামালখানে খুন হয় সাত বছর বয়সী আরেক শিশু। এ ছাড়া নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোরেরা। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণ ও প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুজন ঘোষ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: চট্টগ্রামে একের পর এক শিশু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এই ধরনের ঘটনার কারণ কী হতে পারে?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: এভাবে শিশু হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। আমি অত্যন্ত মর্মাহত। কয়েকটি কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। অন্যতম কারণ হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা রকম অপব্যবহার। আর বিনোদনের নামে বিকৃতভাবে তৈরি ভিডিও প্রচার। এই বিষয়গুলো মানুষের কাছে বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করছে। এর মাধ্যমে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। আর তার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কেন এই ধরনের ঘটনায় কিশোরেরা জড়িয়ে পড়ছে?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: মূলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নত বিশ্বের মতো কোনো ধরনের যৌক্তিক পর্যায়ের যৌনবিষয়ক শিক্ষা বা যৌন আচরণের শিক্ষা দেওয়া হয় না। আবার পরিবারেও তা দেওয়া হয় না। যে কারণে এই ধরনের হত্যা ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে চলছে। আর শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে বিকৃত ভিডিও ও ছবি প্রচারের কারণে কিশোরেরাও অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত আকর্ষণ মেটাতে গিয়ে তারাই আবার নানা প্রলোভনের মাধ্যমে শিশুদের টার্গেট করছে। তাদের তো সংযত আচরণ বা জ্ঞানবোধ কোনোটিই নেই। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। অনেকে ক্ষেত্রবিশেষে নেশাগ্রস্ত হয়ে হিংস্র সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে ন্যূনতম দ্বিধা করছে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বিনোদনের নামে বিকৃত ভিডিও প্রচার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কথা বলছেন। যদি সুনির্দিষ্ট করে বলতেন?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: সুনির্দিষ্ট করে বলতে হলে বলি, বিভিন্ন মিডিয়া বা টিভিতে অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন, নাটক বা চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় অপরাধের কৌশল বলা হয়। বিশেষ করে ক্রাইম প্যাট্রল–জাতীয় টিভি সিরিজের কথা বলতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এগুলো দেখে অনেকেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কৌশল শিখছে, আবার আলামত কীভাবে গায়েব করে দেওয়া যায়, তা–ও জেনে যাচ্ছে। তাই এসব প্রতিবেদন ও নাটক প্রচারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে এসব নাটক বা প্রতিবেদনের প্রভাব আমাদের নতুন প্রজন্মকে আঘাত করতে না পারে, তাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকৃত বিনোদনে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পরিচিতজনদের কাছে অনিরাপদ হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোরেরা। নৃশংসতার শিকার হচ্ছে তাদের হাতে। কীভাবে তা রোধ করা যায়?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। তাঁর সন্তান কার সঙ্গে মেলামেশা করে, কার সঙ্গে স্কুলে যায়, স্কুলের বাইরে কার সঙ্গে মিশছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, এসব বিষয়ে পরিবার থেকে নিবিড় তদারকি করা দরকার। আর কিশোরেরা যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্যও অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে কড়াকড়ি করতে হবে। আর অভিভাবকদের সচেতন করার জন্য এলাকাভিত্তিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বক্তারা এসবের নেতিবাচক ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি তাহলে কীভাবে নিশ্চিত করতে হবে? করণীয় কী?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, কোনো শিশু-কিশোর এই ধরনের নির্মমতা, নৃশংসতার শিকার না হয়, সে বিষয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অভিভাবক, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সর্বোপরি সরকার যদি সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। প্রতিকারের ব্যবস্থায় দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে এই ধরনের ঘটনা বাড়বে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এই নৃশংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কীভাবে দেখছেন?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: এ ধরনের ঘটনায় আইনের প্রয়োগ থাকলেও তা আমাদের কাছে যথেষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে না। আইনের ফাঁকফোকরে অপরাধীরা জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। এরপর মুক্ত হয়ে তারা আরও অধিকতর ভয়ংকর ও নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের রক্ষায় এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে কী করতে হবে?
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: এ ধরনের পরিস্থিতি প্রতিরোধে আইনের সংশোধন করতে হবে। নতুন প্রজন্মের আচরণগত পরিবর্তনে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প নেই। এ ছাড়া কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগ করা জরুরি হয়ে পড়ছে।
প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।