কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নীতিমালা করছে সরকার, কী আছে খসড়ায়
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে। এতে বলা হয়েছে, এআই নিয়ে একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করা হবে। উচ্চপর্যায়ের অংশীজনদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই সেন্টার চালু, সংশ্লিষ্ট খাতে শিক্ষানবিশ প্রোগ্রাম চালু করা এবং এআইভিত্তিক সেবা দিতে গেলে কর্তৃপক্ষের মানসনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকছে।
আইসিটি বিভাগ গতকাল সোমবার জাতীয় এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) নীতিমালা ২০২৪–এর খসড়া প্রকাশ করেছে। খসড়াটি নিয়ে আগামীকাল বুধবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থা/দপ্তরের কর্মকর্তা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করবে আইসিটি বিভাগ।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার ২০২০ সালে জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল প্রণয়ন করে। কিন্তু বর্তমানে বিস্তৃত নীতি গ্রহণের গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার এআই নীতি প্রবর্তন করতে যাচ্ছে। এ নীতিতে এআইয়ের আইনি, নৈতিক ও সামাজিক প্রভাবগুলো মোকাবিলার কথা বলা হয়েছে।
এ নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে এআই উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি গ্রহণে অগ্রগামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরে সহায়তা করতে এটা করা হচ্ছে।
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এআই আইনের খসড়া তৈরি হবে বলে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন।
এআই কী
এআই হচ্ছে বিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে প্রযুক্তি তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তি দিতে পারে, শিখতে পারে। পাশাপাশি তারা এমনভাবে কাজ করতে পারে, যার জন্য সাধারণত মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয়।
এআইয়ের ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। এই প্রযুক্তি তথ্য বিশ্লেষণ ও পরিসংখ্যান, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ভাষাবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, এমনকি দর্শন–মনোবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়েও কাজ করে। বলা হয়, এআই চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নতিসহ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও সহজ করে তুলবে।
ফোর্বসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এআইয়ের নানা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এআই দ্বারা প্রাথমিক রোগ শনাক্তকরণসহ সঠিক রোগ নির্ণয় করা যায়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে এআইয়ের আরও ব্যবহার রয়েছে।
গ্রাহকসেবা দিতে কল সেন্টার বা ভার্চ্যুয়াল সহকারী হিসেবে এআই কাজ করে। আর্থিক খাতে জালিয়াতি ধরাসহ বিভিন্ন ঝুঁকি মূল্যায়নে এআইয়ের ব্যবহার হচ্ছে। উত্পাদনের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ, সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন কাজে এআইয়ের ব্যবহার রয়েছে। এ ছাড়া কৃষি, শিক্ষা, পরিবহন, রিটেইল, জ্বালানি, পরিবেশ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা , নিরাপত্তা, বিনোদনসহ প্রতিনিয়তই এআই ব্যবহারের ক্ষেত্র দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে।
এআইয়ের অপব্যবহার
এআই নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় গত বছরের শুরুতে। এর অপব্যবহারও ঘটছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের লেখক, শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজ ও প্রযুক্তি খাতের ২৬ জন মিলে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিকর ব্যবহার’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়, ডিজিটাল, শারীরিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এআইয়ের অপব্যবহার হতে পারে। এআইয়ের অপব্যহারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্যাকিং, স্প্যাম ই–মেইলের মতো ঝুঁকি আছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সস্তা, বিশ্বাসযোগ্যভাবে ভুয়া ভিডিও ও কনটেন্ট তৈরি করে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। এ ছাড়া এআই ব্যবহার করে নাগরিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে নজরদারি করা, কখনো ক্ষমতা বদলে দেওয়ার মতো হুমকিও রয়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, সন্ত্রাসী, অপরাধমূলক বা রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যে এআইয়ের অপব্যবহার ভয়ংকর মাত্রায় মৃত্যু, ধ্বংস ও গভীর মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এআই নিয়ে দেশে দেশে পদক্ষেপ
ইউরোপীয় ইউনয়ন গত মার্চে এআই আইন অনুমোদন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গত অক্টোবরে এআই নিয়ে একটি নির্বাহী আদেশ দেন। কানাডায় এআই ও ডেটা অ্যাক্ট রয়েছে। ব্রাজিল, চীন আইন নিয়ে কাজ করছে। জাপান ও ইসরায়েলের নীতিমালা রয়েছে। ভারতও এআই আইন নিয়ে কাজ শুরু করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২০৩১ সাল পর্যন্ত এআই নিয়ে কৌশল–নীতি রয়েছে।
সরকারের খসড়া নীতিতে যা আছে
এআইয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার যেসব খাতকে প্রাধান্য দিয়েছে, সেগুলো হলো সরকারি সেবা, শাসন ও বিচারিক ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ, ডেটা গভর্ন্যান্স, নজরদারি, কৃষি, পরিবেশ, জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন, নগর, গণপরিবহন, অর্থ, বাণিজ্য, উৎপাদন ও শিল্প খাত, শিক্ষা, দক্ষতা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা ও উদ্ভাবন।
এআই নীতি বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিল্প খাত, শিক্ষক-গবেষক ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। সরকার একটি স্বাধীন ন্যাশনাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার অব এক্সিলেন্স (এনএআইসিই) প্রতিষ্ঠা করবে এবং এর সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই সেন্টারের কাজ হবে এআই উদ্যোগের সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ করা। তারা এআই উদ্যোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নসহ ঝুঁকি প্রশমনের বিষয়গুলোও দেখবে। একটি জাতীয় এআই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হবে।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে এআই উদ্যোগের নৈতিকতা দেখার জন্য একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হবে, যারা নৈতিকতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেবে। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য এইআইয়ের কৌশল–নীতিও হালনাগাদ করা হবে। এআই নীতি প্রয়োগে গাইডলাইন ও প্রত্যয়নপত্র নির্দেশিকা করা হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আওতাধীন কপিরাইটের বিষয়ও এই নীতির অন্তর্ভুক্ত হবে। বৈশ্বিক বিবেচনায় প্রতি দুই বছরে এআই কৌশল–নীতি পরিবর্তন হবে। এ ছাড়া এআই নীতি প্রতি তিন বছরে পর্যালোচনা করা হবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমে এআই বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে। সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এআই গবেষণা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং তাদের সহাযোগিতা করতে ইউজিসি এআই গবেষণা হাব গড়ে তুলবে।
এআই ইকোসিস্টেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের অবশ্যই এই জাতীয় নীতি ও কৌশলের সঙ্গে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। জাতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এআই-সম্পর্কিত প্রকল্প গ্রহণে একটি ‘একক-উইন্ডো ক্লিয়ারেন্স’ সিস্টেম থাকবে।
বেসরকারি খাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এআই বিষয়ে শিক্ষানবিশ প্রোগ্রাম চালু করবে। সরকারের মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে এআইভিত্তিক উদ্যোগ নিয়ে গবেষণা ও এর উন্নয়নে অর্থায়ন করবে সরকার। এ ছাড়া গবেষণা, উদ্ভাবন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে করছাড় বা কর অব্যাহতি দেওয়া হবে।
সরকার প্রয়োজনে আলাদাভাবে বা এআই–বিষয়ক জাতীয় কৌশলে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামোর মান নির্ধারণ করবে।
দেশে এইআই প্রযুক্তির জন্য কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। সংবেদনশীল বা ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের জন্য সম্মতি নেওয়া, নোটিশ প্রদান এবং তা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। গোপনীয়তার ক্ষেত্রে এনক্রিপশন, বেনামীকরণের বিষয়গুলোও প্রয়োগ করা হবে।
এই নীতির বিষয়ে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এর আগে যে এআই কৌশল গ্রহণ করেছিল, সেখানে কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। তার কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে কয়েকটি মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে স্মার্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা যেত। খসড়া নীতিমালায় উদ্দেশ্যগুলো খুবই সাধারণভাবে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই নীতিমালা দেখে মূলত মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ বাইরে থেকে আসা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ভোগ করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উদ্ভাবনের দিকে নয়।
এআইয়ের জন্য যে কাউন্সিলের কথা বলা আছে, সেখানে কোন সংস্থার কে থাকবেন, সেটা উল্লেখ থাকলেও একাডেমিয়ার প্রতিনিধি/প্রতিনিধিরা থাকবেন বলা আছে। এটা আরেকটু স্পষ্ট করা যেত। এখানে কারিগরি বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ, সমাজবিদ ও দর্শনবিদদের থাকা কাম্য। এ ছাড়া এই কাউন্সিলে মানবাধিকার কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংগঠন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী-শিশু প্রতিনিধি রাখা দরকার। নীতিটি বাংলায় হওয়া প্রয়োজন, যাতে সবাই এটি সহজে বুঝতে পারে।
একটি স্বাধীন সেন্টার গঠন প্রসঙ্গে এরশাদুল করিম বলেন, সেন্টারে যে উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে, তার শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে বেশির ভাগই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত। তাহলে এটা স্বাধীন কমিশন কীভাবে হবে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত প্রস্তাব, ইউনেসকোর ‘এথিকস অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সে’ কী আছে, সেগুলো নীতিমালার সূচনায় উল্লেখ করা যেত।
নীতিমালার খসড়া নিয়ে আলোচনায় উদ্যোগী হওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সাইমুম রেজা তালুকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রক্রিয়ায় সমাজের নানা বিষয় যুক্ত রয়েছে। সে কারণে গণমাধ্যমকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, আইন পেশাজীবী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও সরকার আলোচনা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।