বিপুল ভর্তুকির চাপ সামলাতে সরকার বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করবে। আপাতত এই সমন্বয় মানে দাম বাড়ানো।
প্রথম দফায় দাম বাড়ছে আগামী মাস মার্চ থেকে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ দফায় ইউনিটপ্রতি দর ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা বাড়তে পারে।
দাম বাড়ানোর বিষয়টি জানানোর সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী এ-ও জানিয়েছেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে।
খরচের চেয়ে বেশি দাম নিলে মূল্যবৃদ্ধি বলা যেত। এখন ঘাটতি অনেক, তাই দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। জ্বালানি খরচের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বেই দাম সমন্বয় করা হয়।নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী
সরকার গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পরপর তিন মাস বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ করে বাড়িয়েছিল। এরপর আর বাড়েনি। তবু গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সরকারকে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখতে হয়েছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, এখন গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৬ টাকা ৭০ পয়সা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি কমাতে হলে বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১২ টাকা ১১ পয়সা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকা ২৫ পয়সায়।
ভর্তুকি তুলে নিলে দাম বাড়াতে হবে একসঙ্গে। তবে সেই চাপ সাধারণ মানুষ ও শিল্প খাত নিতে পারবে না। তাই ধাপে ধাপে দাম বাড়াতে চায় সরকার। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আজ বুধবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। পাইকারি ও খুচরা; দুই পর্যায়েই দাম বাড়ানো হতে পারে সরকারি প্রজ্ঞাপনে।
অবশ্য এটিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বলতে নারাজ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, খরচের চেয়ে বেশি দাম নিলে মূল্যবৃদ্ধি বলা যেত। এখন ঘাটতি অনেক, তাই দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। জ্বালানি খরচের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বেই দাম সমন্বয় করা হয়।
কয়লা ও গ্যাসের বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে খরচ কমে আসার কথা, তাহলে খরচ কেন বাড়ছে; এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র করার সময় মার্কিন ডলারের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা ধরে হিসাব করা হয়েছিল। তার চেয়ে ডলারের দাম ৪০ টাকা বেড়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২৯%
চুক্তি অনুসারে দেশি-বিদেশি সব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। তারপর তারা পাইকারি দামে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে।
পিডিবির কর্মকর্তাদের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮ টাকা ৯৬ পয়সা। গত অর্থবছরে এটি ২৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১১ টাকা ৫২ পয়সা।
উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরায় ১৩ দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। বিগত দুই বছর গরমে মানুষকে লোডশেডিংয়েও ভুগতে হয়েছে। কারণ হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যায় না।
এদিকে বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে।
নতুন দাম চলতি ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। প্রতি ইউনিটে ৫ শতাংশ দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ আরও বেড়ে যাবে।
শিল্পকারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে। এ দাম বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গ্যাস খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে বলে দাবি করেছে জ্বালানি বিভাগ।
এর আগে গত বছরের ১৮ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল গ্যাসের দাম। ওই সময় বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ১৭৯ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসার খরচ আরও বাড়বে। তা পরোক্ষভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। নিত্যপণ্য সরবরাহকারী একটি কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বলছে দ্রব্যমূল্য কমানো তাদের অগ্রাধিকার। কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে তো উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।
দাম বাড়ে নির্বাহী আদেশে
এর আগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণশুনানি আয়োজন করে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের কাজটি নিয়মিত করত জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। তাই নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের হাতে নিতে বিইআরসি আইন সংশোধন করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে।
এরপর থেকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত দেওয়া ও মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনার সুযোগ নেই।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তুকি কমানোর নামে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে প্রবল আপত্তি আছে। বিদ্যুৎ খাতে অব্যবহৃত সক্ষমতা ও তার ভাড়া হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণ। তিনি বলেন, মেয়াদ শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন না করা, ‘বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই’ শর্তে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা, পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রকেও চুক্তি সংশোধন করে একই শর্তে আনা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে খরচ কমানো যেতে পারে।