চিকিৎসায় অবহেলার শিকার প্রতি তিনজনে একজন: বিবিএসের জরিপ

দেশের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মানুষের সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে অবহেলা, অযত্ন ও অপচিকিৎসার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গ্রামের চেয়ে শহরে এই হার বেশি। দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ চান, সরকার যেন সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকে।

দেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এই মন্তব্য বা মতামত উঠে এসেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক জনমত জরিপে। কমিশনের অনুরোধে জাতীয় এই জরিপ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক কমিশনের কাছে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। মানুষ কোথায় চিকিৎসা নেন, চিকিৎসার জন্য কত মানুষ বিদেশ যান, ওষুধ নিয়ে ভাবনাসহ স্বাস্থ্য খাত–সংক্রান্ত নানা চিত্র জরিপে উঠে এসেছে।

জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন কাজ করছে। ৩১ মার্চ কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের কাছে জমা দেওয়ার কথা।

দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ চান, সরকার যেন সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকে।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জরিপে অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় মতামত উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের জন্য কমিশনের সদস্যদের চিন্তাকে আরও শক্তিশালী ও সমর্থন দিয়েছে জরিপের পরিসংখ্যান ও মতামত। জনমতের প্রতিফলন থাকবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।

বিবিএস এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ৬৪ জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের ৮ হাজার ২৫৬টি খানার ওপর জরিপ করে। জরিপে প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী একজন নারী বা পুরুষের মতামত নেওয়া হয়। জরিপে ব্যবহৃত প্রশ্নপত্র তৈরিতে জনস্বাস্থ্যবিদদের সহায়তা নেওয়া হয়েছিল।

অবহেলা-অযত্নের অভিযোগ

বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ শোনা যায়। জরিপে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।

দেশের ৩৮ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা, অযত্ন বা অপচিকিৎসার শিকার হন। গ্রামের ৩৬ শতাংশ মানুষ ও শহরের ৪৪ শতাংশ মানুষ এই অভিযোগ তুলেছেন। এসব অভিযোগ নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে প্রায় সমান। সব বয়সী মানুষের মধ্যে এই অভিযোগ প্রায় সমানভাবে দেখা গেছে। লিঙ্গ ও বয়সনির্বিশেষে এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগে (৪৪.২ শতাংশ) এবং সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে (৩২.৩ শতাংশ)।

তবে এমন অভিযোগ জানানোর বিষয়ে মানুষের মধ্যে ধারণার ঘাটতি আছে। জরিপে ৬৫ শতাংশ মানুষ বলেন, তাঁরা জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর ১১ শতাংশ উত্তরদাতার এই বিষয়টি নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। তবে ২৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, তাঁরা জানেন কোথায় অভিযোগ করতে হয়। বিষয়টি জানার হার নারীর চেয়ে পুরুষের এবং গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের মধ্যে বেশি। উল্লেখ্য, চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা, অযত্ন বা অপচিকিৎসার অভিযোগ থাকলে তা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) জানাতে হয়।

বিবিএস এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ৬৪ জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের ৮ হাজার ২৫৬টি খানার ওপর জরিপ করে। জরিপে প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী একজন নারী বা পুরুষের মতামত নেওয়া হয়। জরিপে ব্যবহৃত প্রশ্নপত্র তৈরিতে জনস্বাস্থ্যবিদদের সহায়তা নেওয়া হয়েছিল।

মানুষ কোথায় চিকিৎসা নেয়

জরিপে ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, গত এক বছরে তাঁরা সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সেবা নিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে সেবা নেওয়ার হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি।

সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ চিকিৎসা নেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৩৮ শতাংশ মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলেছেন। এরপর বেশি মানুষ চিকিৎসা নেন জেলা সদর হাসপাতাল ও সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে, যথাক্রমে ২৭ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেও উল্লেখযোগ্য হারে মানুষ (২০ শতাংশ) সেবা নেন।

তবে মানুষ একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে যেমন সেবা নেন, তেমনি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে এবং এনজিওর প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেন। এনজিওর তুলনায় ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মানুষ বারবার সেবা নিতে সবচেয়ে বেশি যায় কমিউনিটি ক্লিনিকে। বছরে গড়ে সাতবার কমিউনিটি ক্লিনিকে যাওয়ার কথা উত্তরদাতারা বলেছেন। অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে মানুষ বছরে গড়ে চারবার যাওয়ার কথা বলেন।

কত মানুষ বিদেশ যান

বিদেশে বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতার বড় একটি দিক। কিন্তু কত মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান, তার সঠিক পরিসংখ্যান হাতে ছিল না। জরিপে বলা হচ্ছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, গত পাঁচ বছরে তিনি নিজে বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গেছেন।

উত্তরদাতারা ১১টা রোগ বা কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছে ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগ, বন্ধ্যত্ব, ডায়াবেটিস, সড়ক দুর্ঘটনা ও আগুনে পোড়া, অর্থোপেডিক, চোখের সমস্যা, স্নায়ুরোগ, মানসিক সমস্যা ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা।

সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশ যান হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায়। বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেখানে যান হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার জন্য। এরপর কিডনি রোগের জন্য যান ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ক্যানসার চিকিৎসার জন্য যান ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

২৭ শতাংশ মানুষ বলেন, এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না থাকলেও দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হতে পারে। বিষয়টিকে সমর্থন করতে পারেননি ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা। বাকি ২ শতাংশ বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না।

ওষুধ নিয়ে ভাবনা

চেম্বারে চিকিৎসকদের সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ করার বিষয়ে উত্তরদাতাদের সমর্থন আছে কি না, জরিপে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, বিষয়টিকে তাঁরা সমর্থন করেন না। ২৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সাক্ষাতের বিষয়টিতে তাঁরা সমর্থন করেন। বাকি ৫ শতাংশ বলেন, এটি নিয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই।

চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের মূল বা জেনেরিক নাম, নাকি কোম্পানির দেওয়া নাম লেখা উচিত—জেনেরিক নাম লেখা উচিত বলে মতামত দিয়েছেন ৪৪ শতাংশ মানুষ, অন্যদিকে ১৭ শতাংশ মানুষ বলেন, কোম্পানির দেওয়া নাম ব্যবহার করা উচিত। তবে ৩২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে একই সঙ্গে জেনেরিক ও কোম্পানির নাম লেখা উচিত। অন্যদিকে ৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, এ বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই।

অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার বেড়েছে। রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিক পান ওষুধের দোকান থেকে। জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিল, একজন এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধের দোকানে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি সমর্থন করেন কি না? ২৭ শতাংশ মানুষ বলেন, এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না থাকলেও দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হতে পারে। বিষয়টিকে সমর্থন করতে পারেননি ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা। বাকি ২ শতাংশ বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না।

সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশ যান হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায়। বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেখানে যান হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার জন্য। এরপর কিডনি রোগের জন্য যান ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ক্যানসার চিকিৎসার জন্য যান ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

দেশে ওষুধের দাম বেশি বা খুব বেশি বলে মতামত দিয়েছেন, ১৩ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা। ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়। ৩ শতাংশ উত্তরদাতার এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই, কিছু মানুষ এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।

সাধারণ মানুষ অভিযোগ করেন, চিকিৎসকেরা রোগীকে বেশি সময় দেন না। রোগীরা একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে কত সময় চান তা স্পষ্ট করে বলেন। ২৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বহির্বিভাগ বা চেম্বারে একজন চিকিৎসকের রোগীপ্রতি কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় দেওয়া উচিত। ১৫ মিনিট ও ১০ মিনিট সময় দেওয়া উচিত বলে মতামত দিয়েছেন যথাক্রমে ২৬ ও ১৯ শতাংশ উত্তরদাতা। কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় দেওয়ার কথা বলেছেন ২৩ শতাংশ মানুষ। ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, চিকিৎসকদের রোগী দেখার সময় পাঁচ মিনিট বা তার চেয়ে কম সময় হলেও চলে।

বাজেট বৃদ্ধিসহ বহু বিষয় আমরা বছরের পর বছর বলে আসছি। জনমত জরিপে স্বাস্থ্য খাতের অনেক দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণ মানুষ কী চান, তা–ও প্রকাশ করেছেন। আশা করি স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ খায়রুল ইসলাম

বরাদ্দ বাড়ানো উচিত

বহুদিন ধরে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ খাত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে তাদের জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে স্বাস্থ্য খাতে; কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ মাত্র ১ শতাংশ বা তার কিছু বেশি। ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলেছেন। ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। বাকি ৩ শতাংশ উত্তরদাতার এ বিষয়ে কোনো মতামত নেই।

দেশের সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। সব মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পান। কোনো মানুষ সেবা না পেলে সরকারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। তবে বহু বছর ধরে আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আলোচনায় আছে। জরিপে বিষয়টি নিয়ে মানুষের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক অধিকার হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন ৯১ শতাংশ উত্তরদাতা। ৪ শতাংশ না সূচক উত্তর দিয়েছেন। বাকি ৫ শতাংশের এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক জনমত জরিপে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেট বৃদ্ধিসহ বহু বিষয় আমরা বছরের পর বছর বলে আসছি। জনমত জরিপে স্বাস্থ্য খাতের অনেক দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণ মানুষ কী চান, তা–ও প্রকাশ করেছেন। আশা করি স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে।’