সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী’ হালিমের শিল্পকর্ম প্রশংসা কুড়াচ্ছে
স্কুল ভবনের ছাদে বা বারান্দার দেয়ালে প্রজাপতি ডানা মেলেছে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে। পাখি উড়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। ৭ মার্চের ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। রয়েছে মহাকাশের ছবি, সচেতনতামূলক কথা ছাড়াও আরও কত কী! রঙিন এ জগতে মন চাইলেই হারিয়ে যাচ্ছে শিশুরা।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনগুলোয় এভাবেই ছবি এঁকে চলেছেন মোহাম্মদ আবদুল হালিম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক পড়ে তাঁর। এরপরই হালিম তাঁর রংতুলি ও দলবল নিয়ে হাজির হন সেখানে। তুলির ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে বিচিত্র সব অবয়ব।
হালিম চারুকলা থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিত্রকলা শেখার সুযোগ পাননি। তাঁর ‘ওস্তাদ’ আবদুস সালামও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আঁকাআঁকি শেখেননি। এই ওস্তাদের কাছেই হাতেখড়ি হালিমের। আঁকাআঁকি শেখার পর তিনি এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
হালিম পড়াশোনা করেছেন এসএসসি পর্যন্ত। তাঁরা চার ভাই, চার বোন। আবদুল হালিমের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। মা মারা গেছেন তিন বছর হলো। আর্থিক অনটনসহ নানা কারণে নিজে বেশি দূর পড়াশোনা করতে না পারলেও দুই ছেলে–মেয়েকে পড়াচ্ছেন হালিম। মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে।
হালিম বলেন, ‘আমি পড়তে পারিনি। এখন খুব আফসোস হয়। বুঝতে পারছি পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। তাই কষ্ট করে হলেও ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছি।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান (স্লিপ) বা বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় আবদুল হালিম স্কুল ভবনে আঁকাআঁকির কাজটি করছেন। এ পরিকল্পনাকে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের প্রারম্ভিক দলিল বা বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হয়। বিভিন্ন স্কুল এ পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ তৈরি, শিখন শেখানো কার্যাবলির জন্য পাঠসংশ্লিষ্ট উপকরণ তৈরি, বিদ্যালয় ভবনের সংস্কার ও সাজসজ্জা খাতে বরাদ্দ পাচ্ছে।
আবদুল হালিম এ পর্যন্ত কয়টি জেলায় বা কয়টি বিদ্যালয়ে আঁকাআঁকি করেছেন, তার হিসাব রাখেননি। তিনি বলেন, ‘কাজ শেষ করার পর সেখান থেকে চলে যাই। আবার অন্য কোনো জায়গা থেকে ডাক পেলে সেখানে যাই। সেভাবে কখনো হিসাব রাখিনি। নোয়াখালী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শেরপুর সদরসহ বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন স্কুলে কাজ করেছি।’
ফেসবুকেও হালিমের কাজের প্রশংসা
আবদুল হালিম সর্বশেষ কাজ করেছেন শরীয়তপুরের একটি বিদ্যালয়ে। এখন রয়েছেন গ্রামের বাড়ি জামালপুর। তাঁর আঁকা ছবিগুলো ফেসবুকে অনেকে শেয়ার দিচ্ছেন, প্রশংসা করছেন। ফেসবুকে যাঁরা হালিমের আঁকা ছবি শেয়ার করছেন, সেখানে তাঁর মুঠোফোন নম্বরটাও দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে তাঁর পরিচিতি বাড়ছে।
হালিম বলেন, ‘আমি বড় মাপের কোনো শিল্পী নই। তারপরও ফেসবুকে অনেকেই আমার আঁকা ছবি শেয়ার করছেন দেখে খুব ভালো লাগে। অবাকও হই।’
নোয়াখালীর সেনবাগের উত্তর গোকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদ উল্লাহ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকে হালিমের আঁকা ছবি দেখেই তাঁকে কাজের জন্য ডেকেছিলেন। স্কুল ভবনের একটি কক্ষে আঁকাআঁকি করেছেন তিনি।
ওই কাজের জন্য আবদুল হালিমকে যে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে, তা পরিশ্রম ও কাজ অনুযায়ী ঠিকই আছে বলে মনে করছেন এই শিক্ষক। হালিমের কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর কাজ ভালো, বেশ সুন্দর।
আবদুল হালিমের কাজ নিয়ে কথা হয় চলতি বছর শেরপুর জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক স্বীকৃতি পাওয়া নূরশেদা আক্তারের সঙ্গে। পূর্বলাভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, শিশুরা পাঠ্যবইয়ে মহাকাশ বা অন্যান্য বিষয়ে যা পড়ে, তা–ই আবদুল হালিম শ্রেণিকক্ষের ছাদে বা বারান্দায় রংতুলি দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন। শিশুরা ক্লাসে বসে মহাকাশ দেখে। সূর্যোদয় দেখে। আঁকার বিষয়গুলো শিক্ষণীয় ও পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্কুলের বাচ্চারাও তাঁর আঁকা খুব পছন্দ করে। এ বিদ্যালয় থেকে দুবার ডাক পেয়েছেন আবদুল হালিম।
শেরপুরের দুধেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, তিন বছর আগে আবদুল হালিম তাঁর বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আঁকাআঁকি করেছিলেন। এই শিক্ষকও আবদুল হালিমের আঁকার প্রশংসা করেন।
প্রায় ৪০ বছর বয়সী আবদুল হালিম বিদ্যালয়ে আঁকাআঁকির পাশাপাশি সাইনবোর্ড লেখা, ভবনের সাজসজ্জাসহ অন্যান্য কাজও করেন। বেশ গর্ব করেই তিনি বললেন, এখন পর্যন্ত তিনি যেসব জায়গা থেকে ডাক পেয়েছেন এবং যে কাজগুলো করেছেন, তা সবাই পছন্দ করেছেন। দর–কষাকষির ভিত্তিতে পারিশ্রমিক নিতে হয়। তাঁর সঙ্গে সহকারী হিসেবে যাঁরা থাকেন, তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়ার পর যে টাকা থাকে, তা দিয়েই সংসার চালান তিনি।
তবে সব সময় হাতে কাজ থাকে না আবদুল হালিমের। এ পেশায় যা আয় করেন, তা থেকে সঞ্চয় করারও তেমন উপায় থাকে না। একটি কাজ করার পর কোনো কোনো সময় দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়। তখন সংসার চালানোটা একটু কষ্টের হয়ে পড়ে। তিনি জানান, তাঁর পরিচিত অন্য যাঁরা আঁকাআঁকিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে পেশা পাল্টে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।
ছোটবেলা থেকেই আঁকতে ভালোবাসেন আবদুল হালিম। তাই তিনি এ পেশা পাল্টাতে চান না। ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও নিজের একটি প্রতিষ্ঠান হবে, সেই স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
আবদুল হালিমের এ কাজ সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সহকারী অধ্যাপক দীপ্তি দত্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেসব এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীরা নেই, সেখানে আবদুল হালিমের মতো শিল্পীরা শিক্ষার্থীদের কাছে চিত্রকর্মকে পরিচিত করে তুলছেন। তাঁর এসব কাজ দেখে অনেক শিক্ষার্থী শিল্পকলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।