বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে নতুন অস্বস্তি সৃষ্টি এড়াতে সচেষ্ট থাকা উচিত

৫ আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে। এমন এক পরিবেশে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকায় এসে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে গেছেন। দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাসের বিরল এই অস্বস্তি কাটানোর প্রথম ধাপ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এই সফরকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির নিরিখে সম্পর্কের ইতিবাচক বিবর্তনের এমন এক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের এই পর্যায়ে কোনো পক্ষের মন্তব্য যাতে নতুন করে অস্বস্তির সৃষ্টির সুযোগ তৈরি না করে, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা উচিত।

উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল গত শুক্রবার বলেছেন, ভারত সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চায়, প্রকাশ্যে যে মন্তব্যই করা হোক, তা যেন ভেবেচিন্তে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করা হয়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবাদপত্রে বাংলাদেশে অতিসম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুশপুত্তলিকা দাহ হয়েছে উল্লেখ করে এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাসের (যা পরে মুছে ফেলা হয়েছে) বিষয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি মানচিত্র পোস্ট করেন, যেখানে বাংলাদেশের মানচিত্রের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো যুক্ত রয়েছে। ‘বিজয় এসেছে, তবে সামগ্রিক নয়/ মুক্তি এখনো বহুত দূরে!’ শিরোনামের ওই পোস্টের একাংশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা ভূগোল ও বন্দোবস্তে আটকা পড়ে গিয়েছি। তাই আমরা বলছি, নূতন ভূগোল ও বন্দোবস্ত লাগবে।’

কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত চার মাসের বেশি সময় ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নানা পর্যায়ে টানাপোড়েন, আগরতলার বাংলাদেশ মিশনে অভূতপূর্ব হামলা, দিল্লি, কলকাতা ও মুম্বাই মিশনের কাছাকাছি এসে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে বিক্ষোভ, ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলবের মতো ঘটনা ঘটেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে পূর্বনির্ধারিত পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক ঢাকায় হয়েছে। বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফরের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। অর্থাৎ ভারতও সম্পর্কের ইতিবাচক উত্তরণে আগ্রহী। এমন এক প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে আলাপ– আলোচনার প্রক্রিয়া চালু থাকা প্রয়োজন। আবার ভারতের জনপরিসরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনকে উপজীব্য করে অপতথ্য ও ভুল তথ্যের বিস্তার থামানো জরুরি। সম্পর্কটা যেন সমতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে পরিবর্তিত সময়ের দাবিকে মেনে নিয়েই হয়, সেটাই বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি সম্পর্কের এই ক্রান্তিলগ্নে এসে কোনো পক্ষের মন্তব্য যাতে নতুন করে অস্বস্তির সৃষ্টির সুযোগ তৈরি না করে, সে ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকা উচিত।

নয়াদিল্লি থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি জানান, গত শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সোয়ালের ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ফেসবুক পোস্ট (মুছে ফেলা) বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া জানতে চান সাংবাদিকেরা।

জবাবে জয়সোয়াল বলেন, ‘ওই মন্তব্যটির বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের প্রতিবাদ জোরালোভাবে জানিয়েছি। সংশ্লিষ্ট পোস্টটি পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় বলে শুনেছি। আমরা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, প্রকাশ্য মন্তব্য যেন ভেবেচিন্তে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করা হয়।’

মুখপাত্র এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা আমরা বারবার বলেছি। সেই ইঙ্গিতও দিয়েছি। এই ধরনের মন্তব্য বুঝিয়ে দেয় জনসমক্ষে মত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হয়।’

বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য এবং সে বিষয়ে বিএনপির হতাশা প্রকাশ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় ব্রিফ্রিংয়ে। জবাবে জয়সোয়াল বলেন, পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশ সফরের সময় এ নিয়ে সরকারি নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন যে ভারত এক গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল বাংলাদেশ চায়, যা সবাইকে নিয়ে গঠিত। মুখপাত্র জানান, পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মানের ওপর নির্ভরশীল এক ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা ভারত বারবার বাংলাদেশকে জানিয়ে এসেছে।

জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার যুক্ততার একটা ধারা তৈরি হয়েছে। এই ধারা বজায় রাখা দরকার। তিনি বলেন, ‘নিকট প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নিতে চাই। কিন্তু ৫ আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক যেন সমতা ও আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে হয়, সেই প্রচেষ্টা যেন বজায় থাকে।’