সংস্কার না হলে অভ্যুত্থান বেহাত হবে

গণ–অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র নিয়ে নানা ধরনের জন–আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছেছবি: প্রথম আলো

নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে ২০২৪ সাল অতিবাহিত হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে সদ্য বিদায়ী এ বছর যে অম্লান হয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ করা চলে না। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশ শতকের দুনিয়ায় ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়ন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ কারণে বিশ্বখ্যাত পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট যথার্থই বাংলাদেশকে বর্ষসেরা দেশ ঘোষণা করেছে। নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন তিনি পার পেয়ে যাবেন। বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে স্রেফ হাসিনা নয়, গোটা আওয়ামী লীগ দল হিসেবে কার্যত আত্মগোপনে। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও অভ্যুত্থান অভিনব কিছু নয়। তবে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান নানা কারণে ভিন্ন তাৎপর্যসমেত হাজির হয়েছে। এর আগে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলকে এত বড় অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়ে আত্মগোপনে যেতে হয়নি। এর জন্য দায়ী বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন।

অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বিস্তর আলাপ-আলোচনা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও চলছে। অনেকে বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলো এত বড় একটি গণ–অভ্যুত্থানকে স্রেফ রেজিম পরিবর্তন হিসেবে দেখতে চাইছে। তাদের দাবি, অতিদ্রুত নির্বাচন দিয়ে ইউনূস সরকারকে বিদায় নিতে হবে৷ অন্যদিকে ছাত্র-জনতার তরফ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার, সংবিধান প্রণয়ন ইত্যাদি ব্যতিরেকে কোনোভাবেই স্রেফ একটি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেওয়ার জন্য এত এত প্রাণ ঝরেনি, এত মানুষ আহত হয়নি। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে অবশ্যই সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে নির্বাচন দিতে হবে। অনির্দিষ্টকাল নির্বাচন পিছিয়ে রাখা যায় না, এ কথা যেমন ঠিক, একইভাবে সংস্কারহীন নির্বাচন আয়োজন জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবে, এ কথাও আলবত সত্য।

বর্তমান নিবন্ধে আমাদের দাবি সামান্য। অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। তবে তার আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারও লাগবে। পত্রপত্রিকা, টক শো এমনকি সভা-সমাবেশ, বক্তৃতায় সংস্কার ও নির্বাচনকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ও সংবিধান সংস্কার করার অর্থ হচ্ছে নির্বাচনকে অস্বীকার করা। অন্যদিকে নির্বাচন চাওয়ার অর্থ দাঁড়িয়েছে সংস্কারের অনিবার্যতা অগ্রাহ্য করা। 

আদতে সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে বিরোধ কল্পনা করা স্রেফ কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, সংস্কারের অনিবার্য ফলাফল হিসেবে আসবে নির্বাচন। অর্থাৎ সংস্কারকাজ সম্পন্ন করলে নির্বাচন আয়োজন করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদায় নিতেই হবে।

তবে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ অনুযায়ী সংস্কার ছাড়া নির্বাচন আয়োজন করলে বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হবে। প্রথম জটিলতাটি বৈধতাসংক্রান্ত। এ সরকার স্রেফ নির্বাচনের নিমিত্তে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। যদি তা–ই হতো, তাহলে এ সরকারকে তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মেয়াদ শেষ করতে হতো। তিন মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ায় স্রেফ নির্বাচন দিয়ে এ সরকার দায়িত্ব শেষ করতে পারে না।

দ্বিতীয় জটিলতা আরও গভীর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন করেছি ঠিকই, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী অভ্যুত্থানের পর দ্বিতীয় সুযোগ এসেছিল, সেবারও রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহায় সংস্কার হয়নি। সংস্কারের উদ্দেশ্যে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠিত হলেও ফলাফল হয়েছে শূন্য। 

ফলে একটি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই নব্বই–পরবর্তী নির্বাচনী ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। এক মেয়াদ পেরোতে না পেরোতেই (১৯৯৬) এ ব্যবস্থা প্রাথমিক হোঁচট খায়। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। গোড়ার ব্যারামের নিরাময় না করে তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক না করে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় দলগুলো একমত হয়।

গভীর পর্যবেক্ষণে নজর এড়ায় না যে সরকার ও রাষ্ট্রের ধ্রুপদি তফাত আমলে না নেওয়ার দরুন সংকট জটিল হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাবলম্বী ও গণতান্ত্রিক না হলে প্রয়োজন হয় সংস্কারের। অন্যদিকে নির্বাচন হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভোটের মাধ্যমে সরকার বেছে নেওয়ার পদ্ধতি। অর্থাৎ সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্ক রাষ্ট্রের; নির্বাচনের সঙ্গে সরকারের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকার ও রাষ্ট্রকে একাকার করে ভাবার দরুন অনেক ক্ষেত্রে আমরা সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি। রাষ্ট্র যদি অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা ফ্যাসিবাদী হয়; সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় সংস্কার ও পুনর্গঠনের। সংস্কার ছাড়া কেবল নির্বাচন গণতন্ত্র নিশ্চিত করে না। একটা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত শাসক স্বৈরতন্ত্রই চাপিয়ে দেয়। এ কারণে নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সমার্থক না ভাবাই শ্রেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক বেছে নেওয়ার উপায়; অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যাপারটা ঠিক এর উল্টো। 

এ কারণে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাই, শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো নজির নেই (১৯৯৬-২০০১ সাল ব্যতিক্রম)। প্রতিবার ক্ষমতাসীন শাসক হয় নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ অথবা ক্যুর শিকার হচ্ছেন; হয় সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করছে অথবা লগি-বৈঠার মতো তাণ্ডবে দেশ প্রায় গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়েছে। আন্দোলন–সংগ্রাম ছাড়া শান্তিপূর্ণ পথে নির্বাচন ও ভোটাধিকার আদায় করা সম্ভব হয়নি। শহীদ নূর হোসেন যে ন্যায়বিচার পাননি, শহীদ আবু সাঈদই তার বড় প্রমাণ। নূর হোসেন চেয়েছিলেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। স্বৈরাচার নিপাত গেছে ঠিকই, ব্যবস্থা আকারে স্বৈরতন্ত্র রয়ে গেছে, গণতন্ত্রের মুক্তি ঘটেনি।

এ দুঃখজনক বাস্তবতা আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার অনিবার্যতার প্রতি নির্দেশ করে। সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনী পথে যাত্রার উদ্দেশ্য এটাই যে আর কেউ যেন মসনদে বসে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার দুরভিসন্ধি না করে। ক্ষমতাসীন সরকার যেন গণ–অভ্যুত্থানের মুখে না পড়ে, গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে চলে না যায় তথা অন্তত বিরোধী দলের রাজনীতি করতে পারে, সে জন্যও সংস্কার প্রয়োজন। আর কোনো নূর হোসেন বা আবু সাঈদকে যেন জীবন বিসর্জন দিয়ে বেইনসাফির শিকার হতে না হয়, তাই রাষ্ট্র সংস্কার জরুরি। 

গণতান্ত্রিক সংবিধান এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রাষ্ট্রকর্মের সীমা নির্ধারিত হয় সংবিধানে। বায়াত্তরের সংবিধান স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শাসক উৎপাদনের কারখানা। জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণ–অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এ সংবিধান কার্যত বাতিল হয়ে গেছে। অন্যদিকে সারা দেশের দেয়ালে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। এ ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে নতুন সংবিধানে সন্নিবেশিত করার কাজটুকুই স্রেফ বাকি। 

নির্বাচন হতেই হবে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধার অবকাশ নেই। তবে তার আগে হতে হবে সংস্কার। এর প্রয়োজনীয়তাও প্রশ্নাতীত। সংবিধান, নির্বাচন, জনপ্রশাসনসহ বেশ কয়েকটি খাতে সংস্কার কমিশনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। তাদের প্রতিবেদনগুলো পাওয়ার পর সরকারের উচিত হবে জনগণের কাছে তা উন্মুক্ত করে মতামত গ্রহণ করা। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সংস্কার প্রশ্নে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর ব্যাপারে জনগণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে। সরকারের উদ্যোগে জেলায় জেলায় উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন হতে পারে। ওই মতামতগুলো সরকার সংরক্ষণ করে পরবর্তী গণপরিষদের কাছে পাঠাবে, যা হবে গণপরিষদ তর্কের ভিত্তি। 

জনগণের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় সংসদ নির্বাচন৷ আর সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হয় গণপরিষদ নির্বাচন যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণকে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেবেন। বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই আগামী নির্বাচনটি হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন, যা সংবিধান প্রণয়ন শেষে আইনসভা তথা সংসদে রূপ নেবে। এ প্রক্রিয়ায় সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একদিকে সংবিধান প্রণয়ন/সংস্কারের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র নির্মূল করবেন। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবেন। অন্যদিকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আইন প্রণয়নও করবেন। তবে গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজনের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে হবে। 

এ ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের একটা টাইমলাইন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে পাওয়া গেছে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে তিনি সংস্কার কার্যক্রম গুছিয়ে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দূরে সরিয়ে রেখে এ সময়কাল আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের স্বার্থে এক হতে পারি। ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী রোল মডেল হয়ে উঠুক, নতুন বছরে এ প্রত্যাশাকে খুব উচ্চাশা বলা যাবে না।

সারোয়ার তুষার: লেখক