বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর গানবোটগুলো মোংলা শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছায়। এ সময় আকাশে দেখা যায় তিনটি জঙ্গি বিমান। শত্রুবিমান ভেবে মো. রুহুল আমিন সহযোদ্ধাদের সেগুলো প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। তাদের বহরে থাকা একটি ভারতীয় গানবোট থেকে জানানো হয়, ওগুলো ভারতীয় বিমান।
বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে এসে বোমাবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। আগেই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কেউ কেউ অক্ষত থাকেন। রুহুল আমিনসহ অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই ছিলেন। বোমার স্প্লিন্টার লেগে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এক সহযোদ্ধা তাঁকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন।
আহত রুহুল আমিন কোনোমতে সাঁতার কেটে নদীর পূর্ব পাড়ে পৌঁছান। সেখানে ছিল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও অনেক রাজাকার। তারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। নদীতীরে পড়ে থাকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা নদীতীরের একটি স্থানে তাঁকে সমাহিত করেন।
চূড়ান্ত যুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নোয়াখালী শহর উদ্ধার করে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে। যৌথ বাহিনীর অন্য দল খুলনার ১৬ মাইল দূরে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর শহর পতনের মুখে।
ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলায় কিছুটা প্রতিরোধ করলেও রাত থেকে টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। জামালপুরে বিকেল চারটার দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়। পাকিস্তানি অধিনায়ক একটি বুলেট কাগজে মুড়ে উত্তর দেয়, অর্থাৎ তারা যুদ্ধ চালাবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানগুলো বোমাবর্ষণ করে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে।
সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে ঢুকতে থাকে। তবে পাকিস্তানি সেনারা ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি তাদের ফাঁদমুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আক্রমণ করে। সকাল প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জসংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেওয়ার সময় পাকিস্তানি ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইনফিল্ডের ফাঁদে পড়ে যায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আশুগঞ্জে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রাতে ভৈরব চলে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়। আশুগঞ্জও মুক্ত হয়। মেঘনা নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সেনারা ভৈরব বাজারের কাছে ঘাঁটি করে।
ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো বারবার ঢাকার চারদিকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এবং সাভার ও নয়ারহাটে রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর হামলা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর নৌ ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে।
ঢাকায় তৎপরতা
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের একটি প্রস্তাব তাঁর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খানের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা হয়। প্রস্তাবে কয়েকটি শর্ত ছিল এ রকম: ১. পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে; ২. বাংলাদেশের গেরিলাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হবে না; ৩. প্রায় এক লাখ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ৪. পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ৫. জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে অধিকৃত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এদিন থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি পরিকল্পনার সূচনা হয়।
সূত্র: একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, প্রথমা প্রকাশন, ২০২৪