সামনে এগোনোর প্রত্যয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়
ঢাকঢোলের বাদ্য বাজছে। শিশু থেকে প্রৌঢ়, নানা বয়সের মানুষ নাচছেন। কারও মাথায় পয়লা বৈশাখ লেখা ব্যান্ড, কারও মাথায় ফুলের মালা। কেউ হাতে নিয়েছেন ছোট চরকি, কেউ মাছ, পাখি, প্যাঁচা, হাতি ও ফুলের আকৃতির রঙিন মুখোশ। পাশে হাঁটছে বিশাল আকারের হাতি, বনরুই, পাখির প্রতীক।
রাজধানীতে পয়লা বৈশাখের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। আজ রোববার সকাল সোয়া ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। শাহবাগ মোড় ঘুরে রমনা টেনিস কমপ্লেক্সের সামনে দিয়ে শিশুপার্কের মোড় ঘুরে আবার শাহবাগ দিয়ে টিএসসি চত্বর ঘুরে চারুকলা অনুষদের সামনে এসে শেষ হয় বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রা।
মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুর আগে সকাল থেকে শাহবাগ এবং চারুকলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য বাঙালিয়ানা সাজে হাজারো উৎসবপ্রেমী মানুষ শাহবাগ থেকে চারুকলা পর্যন্ত সড়কে অবস্থান করেছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন বিদেশিও উপস্থিত হয়েছেন শোভাযাত্রায় অংশ নিতে।
শোভাযাত্রা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল বেশ তৎপর। শোভাযাত্রার শুরুতে ছিল র্যাবের মোটরসাইকেলের টহল টিম। এরপর সোয়াটের সদস্যরা। এরপর পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। একাধিক ড্রোন উড়ছিল। ওয়াচ টাওয়ার থেকেও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েক ধাপের পর মূল শোভাযাত্রা হাঁটতে শুরু করে।
শোভাযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদসহ বিশিষ্ট অতিথিরা।
ঢাকের তালে শোভাযাত্রায় নাচছিলেন পুরান ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন বন্ধু। তাঁদের একজন আদনান আল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, নববর্ষের মূল আকর্ষণ মনে হয় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে। আগে থেকেই এই শোভাযাত্রায় অংশ নিই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে আয়োজিত এই শোভাযাত্রা নববর্ষের পুরো উৎসবকেই বর্ণাঢ্য করে তোলে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালে বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ‘আমরা তো তিমির বিনাশী’। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাংলার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ, গ্রামীণ জীবনের অনুষঙ্গ, পশুপাখি, ফুল—এসবের প্রতীক ও রকমারি মুখোশ বহন করা হয়। এবারও বড় আকারের চাকা, পাখি, ফুল, হাতি, বনরুইয়ের প্রতীক ছিল। আর ছিল বড় আকারের রাজা-রানি ও হাতে বহন করার জন্য ছোট আকারের প্যাঁচা, মাছ, পাখির শতাধিক মুখোশ।
চারুকলা থেকে শুরু করে শাহবাগ মোড়ের দুই পাশেও কয়েক হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা উপভোগ করেন। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পল্লবী এলাকা থেকে এসেছিলেন শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, সকালে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মেট্রোরেলে চড়ে শাহবাগ চলে এসেছি। বাচ্চারা খুবই খুশি হয় এই শোভাযাত্রার আয়োজনে।
পুরুষদের নানা রঙের পাঞ্জাবি আর নারীদের শাড়িতে শোভাযাত্রা আরও রঙিন হয়ে ওঠে। ঘণ্টাব্যাপী এই শোভাযাত্রা টিএসসি মোড় ঘুরে চারুকলায় এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রার শেষ অংশেও ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি।
শোভাযাত্রা শেষে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। এই মূল চেতনা ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বাঙালি সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘প্রতিবছর মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অন্ধকারকে কাটিয়ে আলোর পথে যাব, এটি আমাদের প্রত্যাশা। তরুণসমাজ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। “তিমির বিনাশী” স্লোগান অন্তরে ধারণ করে হবে অগ্রযাত্রা।’