প্রথমবারেই প্রশ্নবিদ্ধ আইসিটি বিভাগের সাইবার নিরাপত্তা পুরস্কার
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সাইবার সচেতনতায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার চালু করে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। কিন্তু প্রথমবারই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে ঘোষিত শর্ত রক্ষা করা হয়নি।
এ বছর প্রথমবারের মতো পাঁচটি বিভাগে ‘বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যাওয়ারনেস অ্যাওয়ার্ড’ দেয় আইসিটি বিভাগ। শর্ত ছিল সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা তৈরিতে অবদান রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। এ ছাড়া গুরুত্ব দেওয়া হবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আবেদনকারীদের।
কিন্তু পাঁচ বিভাগের চারটিতেই পুরস্কার পেয়েছে দেশীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বাইরের রাষ্ট্র বলতে একমাত্র ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান পুরস্কার পেয়েছে। যদিও ভারত স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে পড়ে না। এ ছাড়া বিশেষ স্বীকৃতি বিভাগে পুরস্কার পাওয়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানটির বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
স্বীকৃতি দেওয়া খারাপ নয়, কিন্তু অগ্রাধিকার ঠিক করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা কার্যক্রম আরও জোরদার করা কিংবা এ খাতে লোকবল তৈরিটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
আর ঘোষিত পাঁচটি বিভাগের একটিতে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। নতুন একটি বিভাগ যুক্ত করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুরস্কারের জন্য জমা পড়া আবেদনের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন আয়োজকেরা।
আইসিটি বিভাগের সংস্থা বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ গত বছরের মে মাসে ‘গোল্ডেন জুবিলি কনসার্টের’ আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় এক সংবাদ সম্মেলনে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ (পলক) বলেন, এই কনসার্ট থেকে উপার্জিত অর্থ স্বল্পোন্নত ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজে ব্যয় হবে।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আইসিটি বিভাগের আরেক সংস্থা ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিও (বর্তমানে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি) এই পুরস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। সহ-আয়োজক ও গাইডলাইন তৈরির দায়িত্বে ছিল ইউএনডিপি বাংলাদেশ।
গত জুলাই মাসে ঘোষণায় বলা হয়, পাঁচটি বিভাগের প্রতিটিতে ১০ হাজার ডলার (প্রায় ১১ লাখ টাকা) করে পুরস্কার দেওয়া হবে। বিভাগগুলো হচ্ছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, উদ্যোক্তা, সরকারি কর্মকর্তা বা জনসেবায় সম্পৃক্ত এবং বিশেষ স্বীকৃতি।
গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার্থী বিভাগে সেন্ট যোসেফ স্কুলের শিক্ষার্থী তামজিদ রহমান, উদ্যোক্তা বিভাগে ভারতের ‘এন্ড নাও ফাউন্ডেশন’, সরকারি কর্মকর্তা বিভাগে যৌথভাবে বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) আর বিশেষ বিভাগে ‘পথচলা ফাউন্ডেশনকে’ পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্টার্টআপ নামের একটি বিভাগে পুরস্কার পায় ‘বাইট ক্যাপসুল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও স্টার্টআপ নামের কোনো বিভাগ ছিল না। যোগ্য আবেদন না থাকায় অভিভাবক বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
আইসিটি বিভাগের সংস্থা বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ গত বছরের মে মাসে ‘গোল্ডেন জুবিলি কনসার্টের’ আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় এক সংবাদ সম্মেলনে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ (পলক) বলেন, এই কনসার্ট থেকে উপার্জিত অর্থ স্বল্পোন্নত ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজে ব্যয় হবে।
আবেদনের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থাপনায় বলা হয়, সারা বিশ্ব থেকে তিন হাজারের বেশি আবেদন আসে। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকেই আবেদন গ্রহণ করা হয়। যদিও একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এস এম জাফরউল্লাহ্ বলেন, দুই শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ৩৫টির বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া হয়।
তবে দেশের বাইরে থেকে ঠিক কতটি আবেদন পড়েছে এবং কোন কোন দেশ থেকে আবেদনগুলো পড়েছে, কর্তৃপক্ষ সেটা খোলাসা করে জানায়নি। আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি আবেদন অনেক কম ছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পুরস্কারটির প্রচারণার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যায়নি। পুরস্কারটির জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছিল। আর ফেসবুকে কিছু প্রচারণা চালানো হয়।
কেন একটিমাত্র বিদেশি প্রতিষ্ঠান পুরস্কার পেয়েছে এবং সেটিও স্বল্পোন্নত দেশের নয়, এমন প্রশ্নে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি বলছে, পুরস্কার প্রক্রিয়ার নির্দেশিকা তৈরি করেছে ইউএনডিপি বাংলাদেশ। সিদ্ধান্ত নিয়েছে জুরিবোর্ড।
জুরিবোর্ডে ছিলেন হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক, ইউএনডিপি বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একজন অধ্যাপক এবং দেশের বাইরের দুজন বিশেষজ্ঞ। দুই বিশেষজ্ঞ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবদুল আলিম এবং গুগলের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাইবার নিরাপত্তা নীতির প্রধান তাতিয়ানা বোল্টন।
পুরস্কার প্রদান নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটার জন্য আমরা ইউএনডিপিকে দায়িত্ব দিয়েছি। ওরাই সব করেছে।’
জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন চুয়েটের শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক মোহাম্মদ মশিউল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অল্প কিছু আবেদন পেয়েছেন। সেটার ওপর ভিত্তি করেই নিজের কাজ করেছেন। তবে সংখ্যাটি তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থাপনায় বলা হয়, সারা বিশ্ব থেকে তিন হাজারের বেশি আবেদন আসে। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকেই আবেদন গ্রহণ করা হয়। যদিও একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এস এম জাফরউল্লাহ্ বলেন, দুই শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ৩৫টির বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া হয়।
বিশেষ বিভাগের পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন
বিশেষ স্বীকৃতি বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে পথচলা ফাউন্ডেশন। ওয়েবসাইটে এই বিভাগে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তি বা সংস্থাকে পুরস্কৃত করা হবে।
কিন্তু পুরস্কার পাওয়া পথচলা ফাউন্ডেশন সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছে, এমন কোনো প্রচারণা তাদের ফেসবুক কিংবা ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। সেখানে দেখা যায়, তাদের কাজগুলো বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মনীষা মিম নিপুন পুরস্কার গ্রহণকালে বলেন, তাঁরা দেশের পাঁচটি বিভাগে কাজ করছেন। সাইবার নিগ্রহ রুখতে হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডারসহ এ ধরনের ৩৫৯ জন মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক এই পুরস্কার পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মনীষা প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার নিগ্রহ এবং অনলাইনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে তাঁরা নিজ কমিউনিটির মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেন। দেশের বাইরে বেশ কিছু ফোরামেও তাঁরা যুক্ত এবং সেখানে নিজেদের কথা তুলে ধরেন।
প্রত্যাশা অনুযায়ী আবেদন পড়েনি
পুরস্কার নিয়ে ওঠা প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে লিখিত বক্তব্যে ইউএনডিপি বাংলাদেশের জনসংযোগ বিভাগ বলেছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে পুরস্কার দেওয়ার কথা থাকলেও যেসব আবেদন পড়েছে, সেখানে গুণগত মানের বিষয় ছিল। এ জন্য আয়োজক কর্তৃপক্ষ এবং জুরিবোর্ড যোগ্যতার মানদণ্ডের পরিসর বাড়াতে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আইসিটি বিভাগের লক্ষ্য এমন ব্যক্তি বা সংস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যারা সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এবং প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। সে হিসেবে ভারতীয় আবেদনকারীকে পুরস্কৃত করা হয়। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী আবেদন জমা পড়েনি। অন্যান্য দেশ থেকে যেসব আবেদন জমা পড়েছিল, সেগুলো মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি।
পথচলা ফাউন্ডেশনকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে ইউএনডিপি বলছে, এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যায়। স্টার্টআপ বিভাগ না থাকার পরও এই বিভাগে বাইট ক্যাপসুলকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে ইউএনডিপির ভাষ্য, প্রতিষ্ঠানটিকে উদ্যোক্তা বিভাগে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আইসিটি বিভাগের লক্ষ্য এমন ব্যক্তি বা সংস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যারা সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এবং প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। সে হিসেবে ভারতীয় আবেদনকারীকে পুরস্কৃত করা হয়। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী আবেদন জমা পড়েনি। অন্যান্য দেশ থেকে যেসব আবেদন জমা পড়েছিল, সেগুলো মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি।
যদিও একই বিভাগে ভারতের এন্ড নাও ফাউন্ডেশন পুরস্কার পেয়েছে। অনুষ্ঠানে বাইট ক্যাপসুলের নাম ঘোষণার সময় বিভাগের কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে আইসিটি বিভাগের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্টার্টআপ বিভাগে পুরস্কার দেওয়ার কথা বলা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানের কোনো পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে গোটা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাটাও জরুরি। আর পর্যাপ্ত সাড়া না পেলে এ কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তার দুর্বলতার উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে ব্যবহার করে। প্রায়ই সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা সামনে আসে।
মইনুল হোসেন বলেন, ‘স্বীকৃতি দেওয়া খারাপ নয়, কিন্তু অগ্রাধিকার ঠিক করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা কার্যক্রম আরও জোরদার করা কিংবা এ খাতে লোকবল তৈরিটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’