নারীর ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি অবদান রাখে অর্থনীতিতে

শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীরাও নিজেদের সম্পৃক্ত করছে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিতে, যা অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতেছবি: ফ্রিপিক

ঠাকুরগাঁওয়ের পলি রানী সরকারের এক মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিজেই মেয়েকে পড়ান। কোনো শব্দের অর্থ জানতে বা নতুন কোনো বিষয়ে গুগলে সার্চ করে মেয়েকে শেখানোর পাশাপাশি নিজেও সমৃদ্ধ হচ্ছেন পলি। অথচ মাসদুয়েক আগেও স্মার্টফোনে ফেসবুক ব্যবহার আর ফোন করা ছাড়া ইন্টারনেটের অন্য কোনো ব্যবহার নিয়ে ধারণা ছিল না তাঁর।

নয়াহাট গ্রামের পলি রানী সরকার সম্প্রতি স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। শিশুদের পড়ানোর পাশাপাশি নিজের মেয়েকেও পড়াতে হয় তাঁকে। হাতের মুঠোয় পুরো দুনিয়া থাকায় পলিকে মেয়ের বা স্কুলের শিক্ষার্থীদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চিন্তা করতে হয় না। তবে পলি রানী ইন্টারনেটের বহুবিধ ব্যবহার শিখেছেন গ্রামীণফোনের ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ উদ্যোগে আয়োজিত উঠান বৈঠক থেকে।

পলি রানী প্রথম আলোকে জানান, তিনি সেলাইয়ের কিছু কাজও করেন। এত দিন গতানুগতিক নকশার পোশাক বানালেও এখন নানা নকশার পোশাক বানাতে পারেন। আর এসবই তিনি শিখেছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। অনলাইনভিত্তিক একটি ব্যবসা দাঁড় করানোরও ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।

বাংলাদেশের গ্রামপর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছালেও এর নানা শিক্ষামূলক ও উৎপাদনমূলক ব্যবহার হচ্ছে না। মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) গত অক্টোবরে ‘দ্য স্টেট অব মোবাইল ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের হার শহরে ৪৩ এবং গ্রামে ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মোবাইল ইন্টারনেট সম্পর্কে জানেন, কিন্তু ব্যবহার করেন না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সাক্ষরতা ও ডিজিটাল দক্ষতার অভাব।

তবে ইন্টারনেটের সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহার শেখাতে পারলে পলি রানীর মতো নারীদের নিজেদের সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আয়ের পথও গড়ে দেবে। গাইবান্ধার সাজেদা আক্তার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেনে নিতে পারেন। পাশাপাশি শিশুদের পুষ্টি এবং বেড়ে ওঠা সম্পর্কিত বিষয়ও তিনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানতে পারছেন।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেদের হাতের তৈরি কাজের প্রসার ঘটাতে চান নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের নারীরা
ছবি: প্রথম আলো।

জিএসএমএর ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’–এ বলা হয়, দেশের ৪০ শতাংশ পুরুষ এবং ২৪ শতাংশ নারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারীর ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহের কথা উঠে আসে উল্লিখিত প্রতিবেদনে।

ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের ২০২১ সালের ‘ওমেন অ্যান্ড ই–কমার্স ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ই–কমার্স খাতে নারীদের যদি পুরুষদের সমতায় আনা যায়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় ই-কমার্স বাজারে ২৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি যোগ হবে।

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার গৃহিণী মনি আক্তারের কৃষক স্বামীর আয়ে সংসার চলছিল না। চার বছর আগে তিনি ইন্টারনেট ঘেঁটে সেলাইয়ের কাজ শেখেন। এরপর একটি সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে বসেই মেয়ে ও শিশুদের পোশাক তৈরির কাজ শুরু করেন। এতে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয় তাঁর। এখন ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানোহসহ তাঁর সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা।

আবার ফরিদপুরের রুবিনা আক্তার ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক বানানো শেখেন। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে টুকটাক ফরমায়েশও নেন, যা দিয়ে তাঁর হাতখরচের টাকা উঠে যায়।

প্রশিক্ষণ, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সুবিধা পেলে অর্থনীতিতে নারীরা দ্রুত এগিয়ে যাবেন বলে জানান ইজি অ্যাসিস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা সৈয়দা নওশাদ জাহান প্রমি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীরা যদি ডিজিটালি সাক্ষরতা অর্জন করেন, তাহলে পরিবার যেমন উপকৃত হবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়বে। ছোট ছোট ব্যবসা যাঁদের আছে, তাঁদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ দিলে বড় ব্যবসা গড়ে তুলতে পারবে।’

গ্রামীণ নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযানটি। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি প্রান্তিক নারীদের সরাসরি শেখাতে এ উদ্যোগ। সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নের বেশি স্থানে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে শেষ হয়েছে উঠান বৈঠক। আয়োজনটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক।