জাতীয় জাদুঘর: স্থানসংকট ও সংরক্ষণের দুর্বলতায় ক্ষতির মুখে ৮৯ হাজার নিদর্শন
৪০ বছরের পুরোনো ভ্যাপসা গুদামে নেই কেন্দ্রীয় তাপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। নেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের ব্যবস্থা। এ অবস্থায় বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, শিগগিরই তৈরি হবে বহুতল ভবন আর তাতেই সমাধান হবে নিদর্শনগুলোর প্রদর্শন ও সংরক্ষণ সংকট।
তবে এত দিনেও নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। খবর নিয়ে জানা গেল, স্বয়ং প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নিজেদের স্বার্থে চাননি, জাদুঘরের জন্য হোক নতুন ভবন। এভাবেই স্থানসংকট আর সংরক্ষণের দুর্বলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরের প্রায় ৮৯ হাজার নিদর্শন।
রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরে আছে ৯৪ হাজারের বেশি নিদর্শন। এর মধ্যে আছে দুই হাজার বছরের পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। নিদর্শনগুলোর ৫ শতাংশ থাকে প্রদর্শনের জন্য। বাকি সব থাকে ১৯৮৩ সালে তৈরি এ ভবনের বিভিন্ন স্টোররুম বা গুদামঘরে।
জাদুঘরের মোট ১৮টি গুদামে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৮৯ হাজার নিদর্শন। এর মধ্যে ৭১ হাজারের বেশি ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের। সংরক্ষিত স্থানটিতে প্রবেশের অনুমতি নেই। তবে জাদুঘরের গুদামঘরগুলো সম্পর্কে স্বয়ং কর্তৃপক্ষই সন্তুষ্ট নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানের দুই বিভাগের দুজন কিপার প্রথম আলোকে জানান, অধিকাংশ গুদামঘর ভবনের নিচতলায়। এগুলোর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র নেই। তবে এখানে বন্যা বা বৃষ্টিতে কখনো পানি প্রবেশ করবে না। কিন্তু এটিই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের একমাত্র নিশ্চয়তা নয়। জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য তাপমাত্রা, আর্দ্রতার পরিবর্তন বা আলো পরিমাপের ব্যবস্থা নেই।
প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাপ, আর্দ্রতা, আলো গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মাপ যথাযথ না থাকলে প্রত্নসামগ্রীতে পরিবর্তন শুরু হয়, ক্ষয় হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এটি বোঝা না গেলেও বড় সময়ের ব্যবধানে স্পষ্ট হয় ক্ষতি।
জাদুঘরের সংরক্ষণ রসায়নাগার বিভাগের কিপার মো. আকছারুজ্জামান নুরী প্রথম আলোকে বলেন ‘প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাপ, আর্দ্রতা, আলো গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মাপ যথাযথ না থাকলে প্রত্নসামগ্রীতে পরিবর্তন শুরু হয়, ক্ষয় হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এটি বোঝা না গেলেও বড় সময়ের ব্যবধানে স্পষ্ট হয় ক্ষতি।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের রসায়নাগারের পক্ষে যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ চেষ্টা করে প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তবে তা যথেষ্ট না।’
জাদুঘরের এই কর্মকর্তা জানান, একটি দলিল সংরক্ষণে যে তাপ, আর্দ্রতা, আলোসহায়ক, সেটি একটি ধাতব বস্তুর ক্ষেত্রে একই থাকবে না। যেমন পুরোনো কোনো কাগজের দলিল সংরক্ষণে বাতাসে আর্দ্রতা থাকতে হবে ৫০ শতাংশ, তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে। ধাতুর তৈরি কোনো নিদর্শন সংরক্ষণে আর্দ্রতা ৩০ শতাংশ ও তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির আশপাশে থাকতে হবে। এই সংরক্ষণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলো। আলো প্রবাহের মাত্রাকে লাক্স বলে। জলরং, প্রিন্ট ও চামড়ার মতো নিদর্শন সংরক্ষণে লাক্সের মান থাকবে ৫০–এর মতো। তেল রঙের পেইন্টিং বা কাঠের কাজের নিদর্শনে লাক্স ২০০ থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু জাতীয় জাদুঘরে এসব পরিমাপ ছাড়াই বছরের পর বছর গুদামে রাখতে হচ্ছে মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী।
জাদুঘরের এশিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল আর্ট বিভাগের কিপার ছিলেন স্বপন কুমার দাস। ৩৫ বছর এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে অবসরে যাওয়া এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো কার্বন ডেটিংয়ের (জৈব উপাদান ধারণকারী বস্তুর বয়স নির্ধারণের একটি পদ্ধতি) ব্যবস্থা হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর সময় নির্ধারণ করা হয় এর শৈল্পিক গঠন, উদ্ধারের সময় মাটির গভীরতা—বিষয়গুলো দেখে।’
স্বপন কুমার জানান, সংরক্ষণাগারে যাঁরা আছেন, তাঁরা কাজ করে করে দক্ষ। সংরক্ষণবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ এখনো দেশে তৈরি হয়নি। প্রসঙ্গত, ইংল্যান্ডে ১৮৫৩, জার্মানিতে ১৮৮৮ সালে তৈরি হয়েছে কনজারভেশন সায়েন্স ইনস্টিটিউট। ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, কোরিয়া ও ভারতেও তৈরি হয়েছে এমন ইনস্টিটিউট। অথচ দেশে সংরক্ষণ নিয়ে পড়ালেখা দূরে থাক, জাদুঘরের জন্য নতুন ভবন তৈরির প্রকল্পের বয়সই বাড়ছে বছরের পর বছর।
শুরু হয়নি নতুন ভবন তৈরির কাজ
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বরাবর বলে আসছে, নতুন ভবন হলে সংকটের সমাধান হবে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে একাধিকবার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অচিরেই শুরু হবে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ। জাদুঘর লাগোয়া জাতীয় গণগ্রন্থাগার ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০২২ সালে। একই সময় জাতীয় জাদুঘরের নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করার পরিকল্পনা ছিল। এ আলোচনা চলছে ২০১৮ সাল থেকে।
চলতি সেপ্টেম্বরে খবর নিয়ে জানা গেছে, এখনো পাসই হয়নি বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প। জাদুঘরের পরিকল্পনা উন্নয়ন কর্মকর্তা ছালেহা খাতুন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুইতলা বেজমেন্টসহ ১৩ তলা নতুন ভবন নির্মাণের প্রকল্প এখন আছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে পাস হওয়ার পর যাবে পরিকল্পনা কমিশনে। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৮ কোটি টাকা।’
এ বিলম্বের কারণ সম্পর্কে খবর নিতে গিয়ে জানা গেল আরেক তথ্য। জাদুঘরের কম্পাউন্ডে মূল ভবনের কাছে ভেতরের দিকে আছে চারটি আবাসিক ভবন ও একটি বাংলো। সেখানে বসবাসের ব্যবস্থা আছে জাদুঘরের ৪৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মহাপরিচালকের। নতুন ভবন নির্মাণের প্রাথমিক নকশায় এখানকার ভবন ভাঙার প্রস্তাব থাকায় কর্মকর্তা–কর্মচারীরা এ নিয়ে অনাগ্রহী হয়ে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাদুঘরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা একটি নয়, অনেক। কর্মকর্তাদের অনাগ্রহ দেখে মন্ত্রণালয় পিছিয়ে যায়। আবার জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সঙ্গে একই কম্পাউন্ডে জাদুঘরের ভবন নির্মাণের প্রস্তাবেয়ও কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছিল। একই কম্পাউন্ডে একটিতে প্রবেশের ব্যবস্থা বিনা মূল্যে, অন্যটিতে প্রবেশমূল্যে থাকা নিয়েও নানা মত শুরু হয়। তখন আবার নকশা বদলাতে হয়েছে। না হলে জাদুঘরের ভবনও এত দিনে অনেকখানি তৈরি হয়ে যেত।’
এই কর্মকর্তা বলেন, পরের প্রস্তাবে আবাসিক ভবন বহাল রেখে জাদুঘরের জন্য নতুন করে ভবনের নকশা করা হয়। তবে চারটির মধ্যে একটি আবাসিক ভবন ভাঙতে হবে বলে জানালেন এই কর্মকর্তা।
এসব বিষয়ের সমাধান কী—জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী (৩ সেপ্টেম্বর) মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ বছরের পুরোনো গুদাম, তবু কিপাররা (সংরক্ষকেরা) আলো-বাতাসের ভারসাম্য রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে যে জটিলতা ছিল, সেটির সমাধান হয়েছে। আশা করি, দ্রুত নতুন ভবন তৈরির কাজ শুরু হবে।’
এদিকে জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং নিদর্শন প্রদর্শন বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদের (আইকম) বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাদুঘরের অধিকাংশ নিদর্শনই প্রত্নবস্তু। অথচ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডে কি কোনো জাদুঘরবিশেষজ্ঞ বা প্রত্নতাত্ত্বিক আছেন? সংরক্ষণব্যবস্থাই তৈরি হয়নি এখানে। পরিচালনা কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিতে হবে।’