স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ছুটির দিন ঠিক করা হয়েছিল রোববার। তবে এখন আর রোববার ছুটির দিন নেই। এখন ছুটির দিন শুক্রবার। ছুটির দিন পরিবর্তন করেছিলেন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে ছুটির দিন পরিবর্তনের ঘোষণা কার্যকর করা হয়েছিল।
তবে সিদ্ধান্তটি হয়েছিল ১৯৮৪ সালেরই ১৫ মার্চ। পরদিন পত্রিকায় এ নিয়ে এক কলামের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা ছিল, ‘১লা এপ্রিল হইতে সরকারি অফিসের নয়া কার্যকাল’। ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘পহেলা এপ্রিল হইতে রাজধানীর সরকারী অফিস-আদালতে কার্যকাল পরিবর্তন হইবে। রাজধানীর সচিবালয়, সরকারী বিভাগ, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সদয় কার্যালয়ে অফিস সময় হইবে: সকাল সাড়ে ৭টা হইতে দুপুর ২টা পর্যন্ত। সাপ্তাহিক ছুটি থাকিবে কেবল একদিন, শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন সারা দেশেই হইবে শুক্রবার। ঢাকার বাহিরে সরকারী-আধাসরকারী অফিসগুলির সময়সূচী ১লা এপ্রিল হইতে হইবে সকাল দশটা হইতে বিকাল ৫টা, দুপুরে অর্ধঘণ্টার বিরতি। গতকাল সন্ধ্যায় উচ্চপর্যায়ে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত গত রাতেই সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়।’
এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছিলেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। আর ১৯৮৪ সালের মার্চে যখন এই সিদ্ধান্ত হয়, তখনো এরশাদ ছিলেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এরশাদ তখন উপজেলা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে চলা তীব্র আন্দোলনের মধ্যেই সাপ্তাহিক ছুটি পরিবর্তন করা হয়। সেই উপজেলা নির্বাচন স্থগিত হলেও সাপ্তাহিক ছুটির আর বদল হয়নি। মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে এরশাদ এ রকম নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেন। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষীণ কণ্ঠে এই প্রতিবাদ করেছিল। এরশাদ মূলত ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে ছুটির দিনে পরিবর্তন এনেছিলেন। যদিও এ বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই কোনো দাবি ছিল না।
ছুটির দিন নিয়ে আরেকটি বড় সিদ্ধান্ত এসেছিল ১৯৯৭ সালের ২৯ মে। সেদিন বলা হয়েছিল ৩১ মে থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হবে দুদিন—শুক্র ও শনিবার। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, দুই দিন ছুটির কারণে চাকরিজীবীদের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়বে, জ্বালানি ব্যয় কমবে এবং যানবাহন থেকে সৃষ্ট পরিবেশদূষণও কমবে। এ নিয়েও অবশ্য পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছিল। বিরোধী দল বিএনপি প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছিল। এই দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি বেশি দিন থাকেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই পরিবর্তন করে এবং আবারও সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন, শুক্রবারই রাখা হয়।
সেই বিএনপিই ২০০৫ সালে ৫ সেপ্টেম্বর আবারও ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার নির্ধারণ করে দেয়। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে এই দুই দিন ছুটি কার্যকর হয়। যা এখনো চালু আছে। জ্বালানি সাশ্রয়কে এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল। সরকারের আশা ছিল এতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমবে। যদিও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী নেতারা চেয়েছিলেন রোববার ছুটি থাকুক। কারণ, সারা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ছুটি রোববার। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল মূলত অর্থনৈতিক কারণে।
মুসলিমরা জুমার নামাজ আদায় করেন শুক্রবার। ইহুদিরা ধর্মীয় আচার পালন করেন শনিবার আর খ্রিষ্টানরা চার্চে যান রোববার। সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারণ এই তিনটি বিষয়ের ওপরই মূলত নির্ভর করে। তবে কোনো কোনো দেশ অর্থনৈতিক কারণকেও বেছে নেয়। বিশেষ করে লেনদেনের জন্য বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে সমন্বয়ের কথাই তারা এর কারণ হিসেবে বলে থাকেন।
একটা মজার তথ্য দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি যাঁরা ভোগ করেন, তাঁদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত মার্কিন ব্যবসায়ী হেনরি ফোর্ডের প্রতি। কেননা এক শ বছর আগেও মানুষ সপ্তাহে ছয় দিনই কাজ করত। কেবল ছুটির দিন ছিল রোববার। ফোর্ড গাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ড ১৯২৬ সালে প্রথম তাঁর কর্মচারীদের দুই দিন ছুটি দেওয়া শুরু করেন, শনি ও রোববার। উৎপাদনশীলতায় এর প্রভাব ইতিবাচক হওয়ায় অন্যান্য মার্কিন কোম্পানিও দুই দিন ছুটির ব্যবস্থা করে। এর ছয় বছর পরে মার্কিন সরকার একই নীতি গ্রহণ করলে ১৯৩২ সাল থেকে দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি চাকরিজীবীরা ভোগ করে আসছেন।