রেলওয়ে কর্মীরা কী চান, কর্তৃপক্ষ কী ভাবছে
ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত কর্মচারীরা বাড়তি সময় কাজ করেন। তাই তাঁদের এক মাসের দায়িত্ব দুই মাস কিংবা এর চেয়ে বেশি সময় কাজ করেছেন ধরে বেতন হিসাব করার রীতি ব্রিটিশ আমল থেকেই। এসব কর্মচারী অবসরের পর পেতেন বাড়তি সুবিধা। বিশেষ এই সুবিধা পুরোপুরি দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে অচল হয়ে পড়েছে সরকারের গণপরিবহন রেলওয়ে।
গতকাল সোমবার মধ্যরাত থেকে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করেছেন। রেলের ভাষায়, এসব কর্মচারী রানিং স্টাফ । ফলে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই জটিলতার শুরু ২০২২ সালে। তখন অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়ে দেয় যে, রেলের রানিং স্টাফরা যে বাড়তি সুবিধা পান তা আর দেওয়া হবে না। অবশ্য পরে রানিং স্টাফ, রেল কর্তৃপক্ষ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দর-কষাকষির মাধ্যমে কিছু সুবিধা ফিরে পান রানিং স্টাফরা। কিন্তু এখন ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা সুবিধা পুরোপুরি পুনর্বহাল চান রানিং স্টাফরা। এ দাবিতেই কর্মবিরতি চলছে। রেল কর্তৃপক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোনো সুরাহা আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রানিং স্টাফরা ট্রেন পরিচালনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চালকেরা কাজ না করলে ট্রেন চালানোর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে রেল কর্তৃপক্ষ রানিং স্টাফদের বিষয়ে কঠোর হতে পারছে না। বরং তাঁদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল রেল কর্তৃপক্ষ, এমনকি রেলপথ মন্ত্রণালয়ও।
কিন্তু রানিং স্টাফদের অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয়কে রাজি করিয়ে দাবি বাস্তবায়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে না রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেল কর্তৃপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছেন রানিং স্টাফরা।
রানিং স্টাফদের দাবি কী
রানিং স্টাফরা হলেন, ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত পরিচালক (গার্ড), ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার), সহকারী চালক ও টিকিট পরিদর্শক (টিটিই)। এরা ট্রেন চালানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ ধরনের কর্মী রয়েছেন প্রায় দুই হাজার। তাঁরা সাধারণত দীর্ঘসময় ট্রেনে দায়িত্বপালন করে থাকেন। ট্রেন চালক ও সহকারী চালকের সংখ্যা এক হাজারের কিছু বেশি। পরিচালক ও টিটিই মিলিয়ে রানিং স্টাফের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৯০০ জনের মতো।
দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের (মূল বেতন) হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন তাঁরা। যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ মনে করা হয়। প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। ৮ ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ।
এ ছাড়া অবসরের পর বেসিকের সঙ্গে এর ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। তবে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর এই সুবিধা সীমিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই সময়ের পর নতুন করে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা পুরোনোদের চেয়ে আরও কম সুবিধা পাবেন বলেও সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২২ সালের পর নিয়োগপত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা চলন্ত ট্রেনে দায়িত্বপালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা পাবেন না এবং মাসিক রানিং অ্যালাউন্সের পরিমাণ মূল বেতনের চেয়ে বেশি হবে না। এ ছাড়া অবসরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বশেষ আহরিত মূল বেতনের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পাবেন।
শুরুতে পুরোনো রানিং স্টাফরা সুযোগ-সুবিধা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে নতুন নিয়োগ পাওয়া রানিং স্টাফদেরও আন্দোলনে ভিড়িয়ে নেয় পুরোনোরা। প্রথমে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলন করে। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের নামে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করছেন তারা।
গত ২২ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদান এবং নিয়োগপত্রের দুই শর্ত প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবি জানান রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। তা না হলে ২৮ জানুয়ারি থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধের হুঁশিয়ারি দেন। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম রানিং স্টাফদের বৈঠকে ডাকেন। কিন্তু তাঁরা শর্ত দেয় যে, আগে দাবি মানতে হবে। নতুবা বৈঠকে বসবেন না। পরে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রানিং স্টাফদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। কিন্তু কর্মবিরতির বিষয়ে অনড় থাকেন রানিং স্টাফের নেতারা।
এর আগে ২০২২ সালে ১৩ এপ্রিল কর্মবিরতি পালন করলে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছিল। পরে রেল কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছিল। এরপর কয়েক দফা দাবি উপস্থাপন করেছেন রানিং স্টাফরা। রেল কর্তৃপক্ষও অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এবং বৈঠক করেছে। কিন্তু কোনো সুরাহা সম্ভব হয়নি।
রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের ঢাকা বিভাগের আহ্বায়ক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব মিলে যদি সিদ্ধান্ত জানায় যে, আগামী সাত দিনের মধ্যে বিষয়টির সুরাহা করা হবে তাহলেই তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন। তিনি জানান, দাবি-দাওয়া নিয়ে তারা রেলপথ মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সময় ৯৪টি চিঠি দিয়েছেন। ১৭ বার বৈঠক করেছেন। কিন্তু সংকট নিরসনে আন্তরিক নয় তারা। প্রতিবারই কর্মবিরতি ডাকার পর শেষ মুহূর্তে বৈঠক ডাকা হয়।
রেল কর্তৃপক্ষের অবস্থান
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রথমে অর্থ মন্ত্রণালয় রানিং স্টাফদের বিশেষ সুবিধার পুরোটাই বাতিল করে দিয়েছিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে—সরকারের আর অন্য কোনো কর্মচারীরা এই সুবিধা পায় না। সুতরাং রেলের জন্য বিশেষ সুবিধা বহাল রাখা যাবে না।
কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানায় যে, রেল ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়। রানিং স্টাফদের কাজও ২৪ ঘণ্টা। তাদের সাপ্তাহিক ছুটিও বাতিল করা হয়। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীসহ অন্য কিছু বিশেষায়িত দপ্তরের কর্মচারীরা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই বহাল রাখা হোক। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় প্রথমে মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহাল করে। কিন্তু পেনশনের পর বাড়তি সুবিধা বাতিল এবং নতুনদের জন্য সুবিধা কিছুটা কমানোর সিদ্ধান্ত বহাল রাখে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, রানিং স্টাফদের দাবির বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ আন্তরিক। রেলপথ মন্ত্রণালয়কে তারা বিষয়টি নানাভাবে বুঝিয়েছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়কে রাজি করানো যাচ্ছে না।
আগামী শুক্রবার টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে। প্রতিবার বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাড়তি ট্রেন পরিচালনা করে থাকে রেলওয়ে। এবার ঠিক ইজতেমার আগে কর্মবিরতিতে গিয়ে সরকারের গণপরিবহন সেবাকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও রানিং স্টাফদের সূত্র বলছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে অনেকেই দাবি আদায় করছে। রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির পেছনে এই চিন্তা থাকতে পারে। এটাও সত্য যে, অর্থ মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে ইজতেমাকে সামনে রেখে রানিং স্টাফেরা কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এবার আলোচনার জন্য বৈঠকে ডাকা হলেও এড়িয়ে যাচ্ছেন রানিং স্টাফ আন্দোলনের নেতারা। এ অবস্থায় জটিলতা আরও বাড়ছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আজ সকালে কমলাপুর রেল স্টেশনে পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দাবি-দাওয়া পূরণ রেল বিভাগের হাতে নেই। এটা অর্থ বিভাগের হাতে। আমরা অর্থ বিভাগের কাছে এটা তুলেছি। অর্থ বিভাগ এটা অনেকাংশে এটা পূরণ করে দিয়েছে। দরকার হলে আমরা বাকিটা নিয়েও তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। তিনি কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু রেল বন্ধ করতে পারে না। এতে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।