‘ঘরে যেতে চাই। কিন্তু ঘর কেমন? কোথায় সেটা? আমাকে কি কেউ ভালোবাসবে?’
প্রশ্নগুলো একটি পথশিশুর। তার বঞ্চনার গল্প উঠে এসেছে ‘স্ট্রিট সিচুয়েশন্স ইন বাংলাদেশ ২০২৪’ (বাংলাদেশে পথের পরিস্থিতি) শিরোনামে পথশিশুদের নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটির পাতায় পাতায় অনেক শিশুর কথাই বলা হয়েছে, যারা পথে থাকে।
যেমন আরেক পথশিশু বলেছিল, তাকে প্রতিদিন ১০০ টাকা আয় করতে হতো। নইলে মারধরের শিকার হতে হতো।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) ২য় পর্যায়’ প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ৩৪ লাখ শিশু পথে বাস করছে। শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, পুষ্টিকর খাবারের ঘাটতি আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে ওই শিশুদের।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল– ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সহযোগী সংস্থা হিসেবে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং সুইডেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সিডা। সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পথশিশুদের নিয়ে নানা ধরনের আনুমানিক হিসাব রয়েছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট বাবা-মা নেই, এমন ৩৪ লাখ পথশিশুর জন্মনিবন্ধন করার নির্দেশনা দেন। সেই হিসাব থেকে ধারণা করা যায়, বাবা-মায়ের যত্ন ছাড়া পথে বাস করা শিশুর সংখ্যা ন্যূনতম ৩৪ লাখ। চরম দারিদ্র্য, পারিবারিক অস্থিতিশীলতা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবারগুলোর গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন শিশুদের পথে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক চাপের মুখে ওই শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শিক্ষার পথ বন্ধ হচ্ছে এবং তারা একটি স্থায়ী দারিদ্র্যের চক্রে পড়ে যাচ্ছে।
পথশিশুদের নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ প্রকাশ করা হয় গত বছর এপ্রিলে। ওই জরিপের জন্য ৮টি বিভাগ ও ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন এলাকার ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ পথশিশুকে নির্বাচিত করা হয়। ওই শিশুদের মধ্যে ২৭ শতাংশের বাবা-মায়ের কেউ একজন বা দুজনই মারা গেছেন। ৩৮ শতাংশ শিশু জানিয়েছিল, তারা দারিদ্র্যের কারণে পথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে।
নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, পথের এই শিশুদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো ভিন্ন ভিন্ন। কোনো কোনো শিশু ভাবে, তাদের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক ভালো। কোনো কোনো শিশু জানায়, তারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে চায়। কিন্তু পারে না। বাবা-মায়ের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, বাবা-মায়ের যেকোনো একজনের মৃত্যু, পরিবারে থাকতে হলে আয় করার চাপ এবং নানাভাবে বাড়িতে সহিংসতার শিকার হতে হয় বলে তারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারে না।
পথে বাস করতে গিয়ে নানা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে শিশুরা। গবেষণায় বলা হয়, কাজ করতে গিয়ে তারা নানা ধরনের আঘাত ও দুর্ঘটনার শিকার হয়। একদিকে অপরাধী চক্র তাদের প্রতি সহিংস আচরণ করে, যৌন নিপীড়ন করে; অপরদিকে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার না করে শিশুদের ধরে নিয়ে মারধর করে বলেও গবেষণায় অংশ নেওয়া শিশুরা অভিযোগ করেছে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ১৬ বছরের একটি মেয়েশিশু বলেছিল, ‘আমার মনে হয় না মানুষ আমাদের দেখে। আমাদের দেখলে মানুষ অবহেলা করে। চিৎকার করে। নিপীড়ন করে। আমরা পোকামাকড়ের মতো বিরক্তির কারণ হই।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, দেশে এক কোটির মতো মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে। একটি পরিবার একটি পথশিশুর দায়িত্ব নিয়ে তাদের জীবনের ভয়াবহতা দূর করতে এগিয়ে আসতে পারে। পথশিশুদের জন্য সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী সিমিন হোসেন (রিমি) বলেন, পথশিশুদের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়া সবার দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। উন্নত দেশে ধনীরা যেভাবে দান করেন, সেই মানসিকতা বাংলাদেশে তৈরি হলে পথশিশুদের সংখ্যা অনেক কমে আসবে।
সিমিন হোসেন জানতে চান, পথশিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখ কিসের ভিত্তিতে বলা হলো। তিনি বলেন, ‘তথ্যের মাধ্যমে যত সমৃদ্ধ হব, তত বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ৩৪ লাখ পথশিশু কোনো ধরনের যত্ন ছাড়া পথে বসবাস করছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকে আরও বেশি কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়রুল আলম সেখ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক, বাংলাদেশে ইইউ প্রতিনিধিদলের টিম প্রধান (সমন্বিত সুশাসন) এনরিকো লরেনজোন এবং ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাতালি ম্যাক্কউলে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল। স্বাগত বক্তব্য দেন সিএসপিবি প্রকল্পের (২য় পর্যায়) জাতীয় প্রকল্প পরিচালক মো. ছরোয়ার হোসেন।
গবেষণায় পরিবার থেকে শিশুদের বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকাতে সেবা কার্যক্রমগুলো আরও বাড়ানো, ওই শিশুদের মাদকে আসক্ত হওয়া প্রতিরোধে তাদের আচরণ পরিবর্তনে ব্যবস্থা নেওয়া, পথশিশুদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে পথশিশুদের নিয়ে চিত্র প্রদর্শনী ও নাটক প্রদর্শন করা হয়।