অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়টা চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—এমন একটা অসত্য চিত্র তুলে ধরতে সক্রিয় রয়েছে কিছু গোষ্ঠী। তারা দেশের ভেতরে–বাইরের নির্দিষ্ট একটি পক্ষের হয়ে কাজ করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকার সব মত ও পথের মানুষকে উদারভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে সরকারের এই আন্তরিকতাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে এ কথাগুলো বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক ও সৌদি আরবসহ ঢাকায় প্রায় সব কটি বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূত বা তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনার উপস্থিত না থাকলেও তাঁর একজন সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশবিরোধী বৈশ্বিক প্রচারণার কথা তুলে ধরেন। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনটি দেশ ও জোটের রাষ্ট্রদূতেরা তাঁকে প্রশ্ন করেন।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সামগ্রিকভাবে আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা সরকারের বক্তব্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে কূটনীতিকেরা হিন্দু নেতাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ কীভাবে হচ্ছে, সনাতন ধর্মের লোকজন কতটা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিস্থিতিটা কেমন এবং সংবিধান সংস্কার হলে তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ যাবে কি না—এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করেছেন।
কূটনৈতিক একাধিক সূত্র জানায়, তৌহিদ হোসেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কূটনীতিকদের বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে অপতথ্য, ভুল তথ্য আর মিথ্যা তথ্যের বিস্তার ঘটিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশবিরোধী বৈশ্বিক প্রচারণা
পদ্মায় কূটনীতিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বৈশ্বিক প্রচারণা চালাচ্ছে উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। আমরা মেনে নিচ্ছি, এ ক্ষেত্রে তাদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি। তবে আমরা সবাইকে বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি।’
কারা এই অপপ্রচারে যুক্ত জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটি ভুলে গেলে চলবে না যে একটি বৈশ্বিক প্রচারণা চলছে। পৃথিবীর সবাই যে তাতে অংশগ্রহণ করছে, তেমনও নয়। তবে বৈশ্বিক প্রচারণা চলছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মাধ্যমে। তারা সবখানে আঘাত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রচারণা যে চলছে, এটি আমরা বিদেশি কূটনীতিকদের আজ বলেছি।’
কারা জড়িত, এমন প্রশ্নের উত্তরে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘কোন দেশ করছে এটি আমি বলব না। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান করছে এবং সে প্রতিষ্ঠানগুলোর ধরনটি কী, তা আপনারা ভালো জানেন। এটি আমাদের মেনে নিতে হবে যে যারা এটি করছে, তাদের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানোর ক্ষমতা আমাদের থেকে বেশি।’
বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার ও আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁর অনুসারীরা বিক্ষোভ করতে পেরেছেন। কারণ, এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
কোন দেশের মিডিয়া পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট। এটি প্রধানত ভারতীয় মিডিয়া; কিন্তু এর বাইরেও অনেক মিডিয়ায় ভারতের মিডিয়ার বক্তব্যকে রেফারেন্স করে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা বলতে চাই, সব সরকারের আমলেই বছরে দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। সরকারের কাজ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা সেটি করেছি। তবে দেশ ও দেশের বাইরে এ নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।’
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর জানিয়ে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা বার্তা দিতে চাই, বর্তমান সরকার সাম্প্রদায়িক কোনো অপতৎপরতা বরদাশত করবে না। আমরা হিন্দু-মুসলিম কোনো ভেদ করতে চাই না। কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা গেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাজ্যের অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রতিবেদন একপেশে হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরিতে সেখানে অবস্থানরত একটি বিশেষ গোষ্ঠী প্রভাব রেখেছে। তারা বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনেকে বিদেশে, যেমন জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের এক ফোরামে বা যুক্তরাজ্যে বক্তব্য দিচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা তুলিনি। এটি আমরা সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে তুলব। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিষয়টি তুলব। অত্যন্ত একপেশে রিপোর্ট তারা দিয়েছে। চারটি নির্বাচনকে তারা মোটামুটি একপর্যায়ে ফেলেছে। কিন্তু নির্বাচনগুলো কী মানের সে বিষয়ে একটি শব্দও সেখানে নেই। ১ হাজার ৫০০ ছেলেমেয়েকে হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু এ নিয়ে একটি শব্দও উল্লেখ নেই।’
ব্রিফিংয়ে সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের সমাজের অংশ এবং সরকার এটি বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো মানুষ ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের কারণে নিগৃহীত হবে না, এটি আমরা নিশ্চিত করব।’
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
দুই দেশের সম্পর্কের যে টানাপোড়েন চলছে, ভবিষ্যতে কীভাবে তা সামাল দেওয়া হবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পারস্পরিক স্বার্থ ঠিক রেখে ভারতের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক, ভালো ও সুসম্পর্ক চায় বাংলাদেশ। ভারতের আন্তরিকতা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আন্তরিকতা তো পরিমাপ করা খুব কঠিন কাজ। এটা গণমাধ্যমকে মাপতে হবে। আমি মনে করি, ভারত-বাংলাদেশ উভয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতীয় ভিসা বন্ধ। অনেকে চিকিৎসা নিতে ভারত যেতে পারছেন না। আবার কলকাতার ব্যবসায়ীদের অবস্থা খারাপ, এটা ভারতের স্বার্থ কি না, তাদের দেখতে হবে।
তিন কূটনীতিকের প্রশ্ন
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের পর ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার দুটি প্রশ্ন করেন। তিনি জানতে চান, সংখ্যালঘু নেতাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ কীভাবে হচ্ছে। তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে। ভবিষ্যতেও বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না।
তৌহিদ হোসেন জবাব দেন, সরকার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখছে। তাঁদের অনুরোধ, পরামর্শ বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। আর বিচার বিভাগ এখন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য সরকার কমিশন গঠন করেছে। সেই কমিশনের সংস্কারের সুপারিশ অনুযায়ী বিচার বিভাগে সংস্কার হবে। আশা করা যায়, বিচার বিভাগ ভবিষ্যতে স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যাবে।
অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নার্ডিয়া সিম্পসন জানতে চান, সনাতন ধর্মের লোকজন কতটা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছেন। জবাবে উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে সরকার সচেষ্ট আছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক জানতে চান, তিনি জেনেছেন সংবিধান সংস্কার করা হলে তাতে মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যাবে। আসলে কী ঘটতে চলেছে। জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যাবে, এটা আগ বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কমিশন তাদের মতো কাজ করে চূড়ান্ত সময়সীমা অনুযায়ী সুপারিশ জমা দেবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করা হবে।