১০৮ কোটি টাকা ব্যয়, কাজও শেষ হয়নি

৭ বছরে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। আরও ৩০ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা।

খাবারের দোকান, ফার্মেসিসহ নানা সুবিধা দিতে উদ্যানের ভেতর তৈরি করা হচ্ছে স্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে এসব স্থাপনা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ২০ অক্টোবর ওসমানী উদ্যানেছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে গত সাত বছরে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সেখানে আরও ৩০ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছে সংস্থাটি। বছর বছর খরচের পরিমাণ বাড়লেও এখন পর্যন্ত মানুষ এই উদ্যান ব্যবহার করতে পারছে না। কবে নাগাদ এটি মানুষ ব্যবহার করতে পারবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি।

সবুজে ঘেরা এই উদ্যানের গাছ কেটে নানা অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পরিবেশবাদীরা। তবে বিগত সরকারের আমলে কোনো আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। উল্টো অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা যুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই উদ্যানের পেছনেই ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মানুষের হাঁটার জন্য যে পথ তৈরি করা হয়েছে, তার কয়েকটি স্থানে স্লাব ভেঙে গেছে। কিছু কিছু অংশে স্লাব ভেঙে যাওয়ার পর সংস্কারও করা হয়েছে। পার্কের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থিত দুটি লেকের চারপাশে কংক্রিট দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে। একটি লেকে পানি নেই। আরেকটিতে নোংরা পানি জমে আছে। পার্কের পশ্চিম পাশে বড় আকৃতির যে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। পুরো পার্ক ঘিরে সিটি করপোরেশন যেসব অবকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল, তার একটির কাজও শতভাগ শেষ হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর উদ্যানটির উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছিল। তাঁর মেয়াদেই ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উন্নয়নকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে শেখ ফজলে নূর তাপস সাড়ে চার বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাপসও কাজ শেষ করতে পারেননি।

এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে উদ্যানের উন্নয়নকাজ। গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর প্রায় থমকে গিয়েছিল উন্নয়নকাজ। ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ বলছে, সম্প্রতি বাকি কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠে ৫ শতাংশের বেশি অবকাঠামো করা যায় না। কিন্তু তারা হিসাব করে দেখেছেন সবুজ এই উদ্যানে ২৩ শতাংশ অবকাঠামো করা হয়েছে। উদ্যানের সবুজ পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মূলত দুর্নীতি ও টাকা ভাগাভাগি হয়েছে বলেও মনে করেন এই স্থপতি। তাঁর মতে, ভেতরে মানুষের হাঁটার পথ ও বসার স্থান ছাড়া আর কিছুই করার প্রয়োজন ছিল না।

রাজধানীর গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের উল্টো দিকে ওসমানী উদ্যান। এর এক পাশে সচিবালয়। উদ্যানটির আয়তন প্রায় ২৪ একর। এতে অসংখ্য গাছ ও দুটি জলাশয় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নামে এই উদ্যানের নামকরণ করা হয়েছে।

দ্রুত উন্মুক্ত করে দেওয়ার মানসিকতাই ছিল না

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ওসমানী উদ্যানে একটি পাঠাগার, একটি চত্বরে একাধিক খাবারের দোকান, গাড়ি রাখার স্থান, ব্যায়ামাগার, টেবিল টেনিস ও বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা, এটিএম বুথ, ওষুধের দোকান, নগর জাদুঘর নির্মাণ, শিশুদের খেলার জায়গা, ভলিবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, লেকের পাড় উন্নয়ন, ঘাট তৈরি, মাঠ উন্নয়ন ও বিদ্যুতের উপকেন্দ্র স্থাপনের কাজ করা হচ্ছে।

সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের তিনজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কাজ শুরুর পর ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরে ওই ঠিকাদারকে জরিমানা করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যেই চলে যায় দুই বছর। নতুন ঠিকাদার নিয়োগের পরও কাজে ঢিলেমি ছিল। মূলত উদ্যানের কাজটি দ্রুত শেষ করে মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে, করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এমন মানসিকতা ছিল না। তাই সাত বছর পার হলেও এখনো উদ্যানটি ব্যবহার উপযোগী করে তোলা সম্ভব হয়নি।

‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় এই উদ্যানের উন্নয়নকাজ হচ্ছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ গত জুলাই মাসে শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে আবারও ব্যয় না বাড়িয়ে সময় বাড়াতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ সিটি।

প্রকল্পের পরিচালক খায়রুল বাকের প্রথম আলোকে বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে উদ্যানের বাকি কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। সবুজে ঘেরা একটি পার্কে শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া কতটা যৌক্তিক ছিল, এমন প্রশ্নে খায়রুল বাকের বলেন, তিনি পরে এই প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছেন। কীভাবে এত টাকা খরচ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা তিনি জানেন না।

এই উদ্যানটি নিয়ে ২০২৩ সালের ১৯ মে ‘ঢাকার ‘ফুসফুস’ বন্ধ সাড়ে পাঁচ বছর’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

পান্থকুঞ্জ পার্কেরও একই অবস্থা

কারওয়ান বাজার মোড়ে পান্থকুঞ্জ পার্কের উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এক বছরের মধ্যে পার্কটির উন্নয়নকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ছয় বছরে কাজ শেষ করতে পারেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি। সংস্থাটির প্রকৌশলীদের দাবি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি পথ এই পার্কের এক পাশ দিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁরা যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের উত্তর দিকে একাংশে উন্নয়নকাজ করা হয়েছে। সেখানে হাঁটার পথ তৈরি করে চারদিকে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কর্তৃপক্ষ পার্কের ৫৫ শতাংশ জায়গা নিয়েছে। তারা এই পার্কে ৯ তলাবিশিষ্ট বহুতল ভবন করতে চেয়েছিল। করপোরেশন থেকে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে দেনদরবার করতে করতে অনেক সময় চলে গেছে। পরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ব্যবহার করা জায়গা বাদ দিয়ে বাকি অংশে উন্নয়ন করা হয়েছে।

সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ছোট আকৃতির এই পার্কের উন্নয়নে ১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। জায়গা কমে যাওয়ার কারণে ছয় থেকে সাত কোটি টাকার মতো খরচ হবে।

পকেট ভরতে কংক্রিটের জঞ্জাল

উদ্যান মানেই সবুজের সমাহার। সেখানে চাইলে ন্যূনতম পর্যায়ে উন্নয়ন করা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের কিছু ব্যক্তি তাঁদের পকেট ভরতে গিয়ে সবুজ উদ্যানকে কংক্রিটের জঞ্জাল বানিয়ে ফেলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, বিগত সময়ে অপ্রয়োজনীয় কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে উদ্যান ও পার্কের চরিত্রকেই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ওসমানী উদ্যানে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে কেন এত ব্যয় হয়েছে, এ নিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন।

আর পান্থকুঞ্জ পার্কের বিষয়ে এই নগর–পরিকল্পনাবিদ বলেন, কাঁঠালবাগান ও এর আশপাশের এলাকার মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সদিচ্ছা থাকলে অনেক আগেই সিটি করপোরেশন এই পার্ক চালু করতে পারত। খামখেয়ালির কারণে মানুষকে পার্ক ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করেছে তারা।