দিনাজপুর বোর্ড
৬ বিষয়ের এসএসসি প্রশ্নপত্র ফাঁস, কেন্দ্রসচিবই জড়িত
কুড়িগ্রামে এক কেন্দ্রসচিবের বইয়ের তাকে পাওয়া গেল ছয় বিষয়ের প্রশ্নপত্র। কেন্দ্রসচিবসহ তিন শিক্ষক গ্রেপ্তার।
একটি–দুটি নয়—ফাঁস হয়েছে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র। আর ফাঁসে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি একজন কেন্দ্রসচিব, যাঁর দায়িত্ব হলো নিরাপদে প্রশ্নপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।
এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। ঘটনাটি ধরা পড়ে গত মঙ্গলবার। এরপর গতকাল বুধবার চারটি বিষয়—গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও রসায়নের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। বাকি দুই বিষয় উচ্চতর গণিত ও জীববিদ্যার পরীক্ষা নতুন প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে নির্ধারিত সময়েই নেওয়া হবে।
দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে এবার প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তাদের পরীক্ষার সূচিতে বিঘ্ন ঘটল। বোর্ডভেদে আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয় বলে দেশের অন্য বোর্ডের পরীক্ষা যথাসময়ে হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে ভূরুঙ্গামারী থানায় মামলা হয়। মামলায় উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রের সচিব মো. লুৎফর রহমান, সহকারী শিক্ষক মো. জোবাইর হোসেন ও মো. আমিনুর রহমান, বিদ্যালয়টির অফিস সহকারী মো. আবু হানিফসহ অজ্ঞাতনামা ১০-১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান এবং শিক্ষক জোবাইর হোসেন ও আমিনুরকে। তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
দেশে ২০১৯ সালের আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠা একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যার মধ্যে ছিল পরীক্ষা শুরুর আগমুহূর্তে প্রশ্নপত্রের ‘সেট’ (যে প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে) জানানো, দায়িত্বপ্রাপ্তদের মুঠোফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, ইন্টারনেটের গতি কমানো ইত্যাদি। এবারের এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছিল, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ নেই। কিন্তু দিনাজপুর বোর্ডের ঘটনায় দেখা গেল, পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে বলেন, ‘কাউকে না কাউকে দিয়ে তো কাজটি করাতে হবে। আমি কার ওপর বিশ্বাস রাখব।’ তিনি বলেন, তদন্তে বেরিয়ে আসবে কীভাবে কী হলো, দুর্বলতা কোথায় ছিল। পুলিশের তদন্ত চলছে।
যেভাবে জানা গেল
স্থানীয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, যে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা শিক্ষা বোর্ড স্বীকার করেছে, তার বাইরে আরও একাধিক বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূরুঙ্গামারীর একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে পড়তে গিয়ে কিছু শিক্ষার্থী ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা জানায়। গত সোমবার ওই বিষয়ের পরীক্ষা শেষে তিনি আগে ছড়িয়ে পড়া হাতে লেখা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মিলিয়ে দেখেন। এতে হুবহু মিল পাওয়া যায়। এরপর তিনি বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান। সাংবাদিকেরা তা প্রশাসনকে জানান।
শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শুরুতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানোর পর সবাই নড়েচড়ে বসে। একপর্যায়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. কামরুল ইসলাম, বোর্ড সচিব মো. জহির উদ্দিন কুড়িগ্রামে যান। তাঁরা কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলামকে নিয়ে ভূরুঙ্গামারীতে গিয়ে থানায় রাখা প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের সংখ্যা যাচাই করে জানতে পারেন যে সেখানে পরবর্তী পরীক্ষার কিছু প্রশ্নপত্রে নেই।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় করা মামলার বাদী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আদম মালিক চৌধুরী, যিনি ভূরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত (ট্যাগ) কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত মঙ্গলবার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা শেষে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার শর্মার উপস্থিতিতে কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমানকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি একপর্যায়ে স্বীকার করেন, তাঁর কাছে পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রয়েছে। এরপর কেন্দ্রসচিবের অফিসকক্ষের বইয়ের তাক (বুকশেলফ) থেকে একটি কাপড়ের ব্যাগে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের প্যাকেট বের করা হয়, যার মধ্যে একটি ছাড়া সব কটি প্যাকেটের মুখ খোলা ছিল।
তখন পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সাঈদ মো. আতিক নুর প্রশ্নপত্রগুলো জব্দ করেন এবং আসামিকে হেফাজতে নেন বলে উল্লেখ করা হয় এজাহারে। এতে আরও বলা হয়, কেন্দ্রসচিব জিজ্ঞাসাবাদে জানান, পূর্বপরিকল্পিতভাবে অপর আসামি মো. আবু হানিফের সহায়তায় কৌশলে ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের মধ্যে করে পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রগুলো নিয়ে আসেন তিনি। পরে অন্য আসামিদের মাধ্যমে গোপনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ভূরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের কেন্দ্রসচিব ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান এক দশক ধরে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গাফিলতি কি না, প্রশ্ন
১১টি বোর্ডের অধীনে এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয় (বিজি প্রেস) থেকে প্রশ্নপত্র ছাপানোর পর তা জেলায় পাঠানো হয়। থাকে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে (ট্রেজারিতে)। সাধারণত পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে জেলা সদরের প্রশ্নপত্রগুলো জেলা প্রশাসনের কাছে রেখে বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট উপজেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উপজেলায় প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ করা হয় সাধারণত থানায়। এরপর নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রওয়ারি প্রশ্নপত্রগুলো ঠিকমতো এল কি না, তা একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে কেন্দ্রসচিব ও একজন পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই (সর্টিং) করা হয়। বাছাইয়ের পর আবার প্যাকেটে (মোড়ক) ভরে প্রশ্নপত্র সেখানেই রাখা হয়।
নিয়ম হলো, যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা হবে, সেদিন সকালে নির্ধারিত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র নেওয়া হবে। এরপর পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কোন সেট প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে, তা জানানো হবে। আর প্রতিটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র নেওয়ার জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া থাকে (ট্যাগ কর্মকর্তা)। এটি ঠিক করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ট্যাগ কর্মকর্তা, কেন্দ্রসচিব ও একজন পুলিশ সদস্য মিলে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে নিয়ে যান।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করছেন ভূরুঙ্গামারীতে বাছাইয়ের সময়ই পরবর্তী পরীক্ষার কিছুসংখ্যক প্রশ্নপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে থানায় গিয়ে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা দেখতে পান কর্মকর্তারা। এমনও হতে পারে যে ‘যোগসাজশে’ প্রথম পরীক্ষার দিন পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কৌশলে নেওয়া হয়েছে। অথবা দায়িত্বপ্রাপ্তদের গাফিলতি রয়েছে। নইলে প্রশ্নপত্র নেওয়া সম্ভব নয়।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে যদি দেখা যায় কোনো কর্মকর্তা জড়িত, তাহলে তাঁকেও ধরা হবে।
অভিভাবকদের উদ্বেগ
অভিযোগ আছে, পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র দেওয়া হতো। শুধু কুড়িগ্রামে নয়, রংপুরেও প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হতো। অভিভাবকেরা বলছেন, মায়েদের ডেকে তাঁদের সন্তানদের জিপিএ–৫ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকায় প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হতো। চক্রটি কয়েক বছর ধরে কাজটি করছিল। অভিভাবকেরা চান, আগের পরীক্ষাগুলোয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কি না, তা তদন্ত করা হোক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি তদন্ত করে পুরো চক্রকে গ্রেপ্তার করুক।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রসচিব যে কাজটি করেছেন, তা অনৈতিক ও অপরাধ। তবে শুধু তাঁকে ষোলো আনা দায়ী করলে হবে না। কারণ, দায়িত্বটি যৌথ। এখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেখা উচিত ছিল যে প্রশ্নপত্র বিতরণ ঠিকমতো হয়েছে কি না।