অনেকের কাছ থেকে ‘ভিক্ষা করার পরামর্শ’ পাওয়া নাজিম এখন উদ্যোক্তা
‘মনের জোরে চলি’—অসুস্থতা নিয়েও কাজ করা অনেকের মুখে কথাটা শোনা যায়। তবে সত্যিকার অর্থেই মনের জোরে চলেন মুহাম্মদ নাজিম (২৩)। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চার বছর আগে দুই হাত ও দুই পা হারানো এই তরুণ ‘উঠে দাঁড়িয়েছেন’ শুধু মানসিক শক্তির জোরে। জোর গলায় বলতে পারছেন, ‘আমি শারীরিকভাবে পরনির্ভর, কিন্তু মানসিকভাবে আত্মনির্ভর।’
নাজিম বহুবার আশপাশের লোকজনকে বলতে শুনেছেন, ‘এমন জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।’ অনেকে তাঁকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘তুই ভিক্ষা কর। এ ছাড়া কিছু করতে পারবি না।’ এরপর এমন কয়েকজন মানুষের সঙ্গে নাজিমের দেখা হয়, যাঁরা তাঁকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, তাঁর জেদকে উসকে দিয়ে উদ্যোক্তা হতে মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন।
হাত-পা হারানো নাজিম এখন একজন উদ্যোক্তা। ফেসবুকে তাঁর উদ্যোগের নাম ‘উলিয়া বাজার ডট বিডি’ (UliaBazar.bd)। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ঘি, চিয়া সিড, মধু ও মধু মেশানো বাদাম বিক্রি করেন তিনি। মৌসুম এলে বিক্রি করেন আম আর খেজুরের গুড়। নাজিম তাঁর ফেসবুক পেজের নাম দিয়েছেন নিজের গ্রামের বাজারের নামে।
নাজিম থাকেন রাজধানীর পূর্ব রামপুরার তিতাস রোডে একটি ভাড়া বাসায়। ১০ নভেম্বর দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি পরে শুয়ে আছেন নাজিম। শুরুতে ক্রিকেট নিয়েই কথা। নাজিম বললেন, ‘নিজের দেশের দল যেমনই খেলুক, সমর্থন না দিয়ে থাকা যায় না।’ বিশ্বকাপের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের বিরুদ্ধে সাকিব আল হাসানের টাইমড আউটের আবেদন নিয়ে বললেন, ‘নিয়মের মধ্যেই হয়েছে। সমালোচনা করার তো কিছু নেই।’
নাজিমের চিকিৎসায় তাঁর পরিবারের পৌনে আট লাখ টাকা খরচ হয়। বিক্রি করতে হয় একমাত্র সম্পত্তি ভিটেবাড়ি। তাঁর বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কতজন যে দেখতে এসে বলত, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলে ভালো হতো। তবে ছেলে তো আমার। বেঁচে আছে বলে ওর কথা শুনতে পাই। এর চেয়ে শান্তি কিছু হতে পারে!’
দুই কক্ষের ভাড়া বাসাটির এক কক্ষে আসবাব দিয়ে কিছুটা আড়াল করা নাজিমের শোবার জায়গা। ওই কক্ষেই আরেক পাশে দুই বছরের ছোট বোনকে নিয়ে মা–বাবা থাকেন। অপর কক্ষে তাঁর মামা থাকেন স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে। এ কথা-সে কথার পর সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা বলতে শুরু করেন নাজিম, তাঁর মা–বাবা ও মামা।
লোকজন বলছিলেন, ‘মরে গেছে, মরে গেছে’
তিন ভাই-বোনের মধ্যে নাজিম বড়। ছোটবেলায় জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার পলবান্ধা ইউনিয়নের উজানপাড়ার গ্রামের বাড়ি থেকে মা–বাবার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। বাবা মো. শফিকুল ইসলাম রিকশাচালক। মা নাসিমা বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন। আর্থিক অনটনে নাজিমের পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস। ছোট এক বোনের বিয়ে হয়েছে। তিনি গ্রামে থাকেন।
২০১৯ সালে ১৯ বছর বয়সে গাড়ি চালানো শিখে একজনের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কাজে যোগ দেন নাজিম। তবে সে চাকরি ছয় মাসের বেশি করতে পারেননি। অভাবের কারণে বসে থাকার উপায়ও ছিল না। কিন্তু কোনো কাজ পাচ্ছিলেন না। এ সময় বাসার কাছে মসজিদের অজুখানা নির্মাণকাজে সহকারী হিসেবে যোগ দেন তিনি।
সেই কাজ চলাকালে একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। সেদিন ১ অক্টোবর। মসজিদের নিচতলা থেকে একজন সহকারী নির্মাণকাজের রড ওপরের দিকে তুলে দিচ্ছিলেন। তিনতলা থেকে সেই রড টেনে তুলছিলেন নাজিম। একপর্যায়ে একটি রড তোলার সময় তাঁর ভারসাম্য নষ্ট হয়। রডটির এক প্রান্ত রাস্তায় হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের তার স্পর্শ করে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন নাজিম।
নাজিম বলেন, ‘আমি সাড়া দিতে পারছিলাম না। কিন্তু লোকজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। লোকজন বলছিল, “মরে গেছে, মরে গেছে।”’
এর পরের ঘটনাগুলো নাজিমের পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনেছেন। নাজিমের মামা মো. সোহেল বলেন, নাজিমের হাতে ধরা রডটি বিদ্যুতের তারে লেগে গরমে টকটকে লাল হয়ে যায়। তিনতলার মেঝে স্যাঁতসেঁতে ছিল। সেখানে স্যান্ডেল পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাজিম। মুহূর্তে তাঁর হাত-পায়ে আগুন ধরে যায়। তিনি চিৎকার দিয়ে মেঝেতে পড়ে যান। লোকজন ভয়ে তাঁর কাছে যাচ্ছিলেন না। বেশ কিছু সময় পর মসজিদের খাদেম গিয়ে আগুন নেভান। এরপর কয়েকজন ধরাধরি করে নাজিমকে নিচে নামান।
নাজিম বলেন, ‘আমি সাড়া দিতে পারছিলাম না। কিন্তু লোকজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। লোকজন বলছিল, “মরে গেছে, মরে গেছে।” নিচে নামানোর সময় প্রচণ্ড ব্যথায় আমি চোখ খুলি। লোকজনকে বলি, আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।’
নাজিমের মামা মো. সোহেল বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক নাজিমকে দেখে আফসোসের সুরে বলে উঠেছিলেন, ‘ইশ্, ছেলেটার হাত-পা রাখা যাবে না!’ এর পরের এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর দুই হাত এবং ২০ দিনের মধ্যে এক পা কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। অপর পায়ে পচন ধরলে এক মাস পর সেটিও কেটে ফেলা হয়।
নাজিমের চিকিৎসায় তাঁর পরিবারের পৌনে আট লাখ টাকা খরচ হয়। বিক্রি করতে হয় একমাত্র সম্পত্তি ভিটেবাড়ি। তাঁর বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কতজন যে দেখতে এসে বলত, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলে ভালো হতো। তবে ছেলে তো আমার। বেঁচে আছে বলে ওর কথা শুনতে পাই। এর চেয়ে শান্তি কিছু হতে পারে!’
কথা বলার এক পর্যায়ে আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেন না নাজিম। মাথা নিচু করে জার্সিতে চোখের জল মোছার চেষ্টা করছিলেন। একসময় বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন তিনি। নাজিমের অভিমান আরও অনেক কিছু নিয়েই। তিনি জানান, প্রতিবন্ধী কার্ড করতে গেলে তাঁকে বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গেলে প্রতিবন্ধী কার্ড আগে করতে হবে বলে ফেরত পাঠানো হয়। আর যেতে ইচ্ছা হয়নি তাঁর।
যেভাবে উদ্যোক্তা হলেন
বিছানায় শুয়ে-বসে থাকার দিনগুলোতে অন্যদের কথা শুনে নাজিমের কখনো কখনো মনে হয়েছিল, ‘সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো।’ ২০২১ সালের শেষ দিকে এলাকার আরিফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি এসে তাঁকে বলেন, ‘আপনি তো বসেই থাকেন। ভালো লাগলে কিছু কাজ করতে পারেন।’
আরিফুল তখন নাজিমকে ‘নিজের বলার মতো একটি গল্প’ নামে ফেসবুক পেজে যুক্ত হতে বলেন। নাজিম বলেন, ওই পেজে যুক্ত হয়ে দেখেন, তাঁর মতো কয়েকজন সেখানে আছেন। পেজে বিভিন্ন অনলাইন ভিডিওতে উদ্দীপনামূলক কথা প্রচার করা হতো। সেসব দেখে তাঁর ভেতরে স্বপ্ন তৈরি হয়।
তবে নাজিমের কোনো পুঁজি ছিল না। ২০২২ সালের শেষ দিকে রি-সেলার, অর্থাৎ আরেকজনের পণ্য বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। সে বছরের ১৪ জানুয়ারি নিজের প্রথম পণ্য বিক্রি করেন তিনি।
তবে নাজিমের কোনো পুঁজি ছিল না। ২০২২ সালের শেষ দিকে রি-সেলার, অর্থাৎ আরেকজনের পণ্য বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। সে বছরের ১৪ জানুয়ারি নিজের প্রথম পণ্য বিক্রি করেন তিনি। চট্টগ্রামের একজন তাঁর কাছ থেকে এক লিটার মধু কেনেন। এখন ‘উই’ নামে একটি গ্রুপেও পণ্যের ছবি পোস্ট করেন। সেটি নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম হলেও প্রতিবন্ধী হিসেবে স্থান পেয়েছেন নাজিম।
মা নাসিমা বেগম নাজিমের দৈনন্দিন সব কাজে সাহায্য করেন। নাজিমের ব্যবসার পণ্য প্যাকেট করা, পাঠানো, গ্রহণ করার কাজ করেন তিনি ও তাঁর ভাই (নাজিমের মামা)। নাসিমা বেগম জানালেন, চার বছর আগে ছেলে যেদিন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন, সেদিনটি এখনো তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। সেদিনের কথা মনে পড়লে বুক কেঁপে ওঠে তাঁর।
বাঁ হাতটি কনুই পর্যন্ত থাকায় নাজিম মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারেন। নাজিম জানান, ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ, ফেসবুক পেজ চালানো, পণ্যের ছবি পোস্ট, বিভিন্ন স্ট্যাটাস দেওয়া, অন্য পেজে উদ্যোক্তাদের স্ট্যাটাসে লাইক-কমেন্ট করে নিজেকে পরিচিত করার কাজগুলো তিনি নিজেই করেন।
নাজিম বলেন, ‘মামার স্মার্টফোন নিয়ে শুরুতে চেষ্টা করে দেখি মুঠোফোন চালাতে পারব কি না। কয়েক দিনের চর্চায় ফোন ব্যবহার রপ্ত করার পর স্মার্টফোন কিনি।’ ‘নিজের বলার মতো একটি গল্প’ পেজের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল বাহার জাহিদের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হতেন। কনুইয়ের ওপর ফোন রেখে নিজের বক্তব্য ভিডিও করতেন। এভাবে চর্চা করতে করতে কথা বলায় জড়তা চলে গেছে। গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছেন।
এখন মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয় নাজিমের। আগে সারা দিন শুয়ে-বসে থাকার সময় কখনো কল্পনাও করেননি, মাসে এই টাকা আয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব। এখন ছোট উদ্যোগটিকে বড় করার স্বপ্ন দেখেন, যাতে স্বাবলম্বী হতে পারেন তিনি। একটি কথা নাজিমের খুব পছন্দ—‘স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া, মেঘ দেখে কেন ভয় পাওয়া’। তাই শারীরিক প্রতিবন্ধিতা ছাপিয়ে স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে চান তিনি।