ঋণ ও আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চাপে ফেলেছে ভোক্তাদের
ঋণ ও আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে ভোক্তাদের চাপে ফেলা হয়েছে। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এই আমদানিনির্ভরতা আগামী দিনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ঋণ পরিশোধ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
আজ বুধবার রাজধানীতে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দেওয়ায় জমি দখল, কৃষিজমি হারানো, হত্যা, গ্রামবাসীদের ওপর হামলা ও গণহারে মামলা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ফলে জ্বালানি খাতে ন্যায্যতা ও সমতা হারাচ্ছে জনগণ।
জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘জ্বালানি রূপান্তরে সুবিচার চাই’ শিরোনামে আয়োজিত সভায় বক্তারা জ্বালানির জন্য বিদেশ থেকে কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশের সম্পদ ব্যবহারের ওপর জোর দেন। তাঁরা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান (বিইআরসি) আইনের সংশোধনী বাতিল করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য হার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসিকে ফিরিয়ে দেওয়া, দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন বাতিল ও জ্বালানি খাতে অপরাধের বিচার করার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, জ্বালানি খাতে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সরকারের দিক দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল হচ্ছে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও জ্বালানিবিষয়ক গবেষক আরিফুজ্জামান তুহিন। মূল প্রবন্ধে বেসরকারি খাতে তিনটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, যতখানি জমির প্রয়োজন, তার চেয়েও বেশি জমি দখল করা হয়েছে। খাসজমিও নেওয়া হয়েছে। অনেক কৃষিজমি দখল করায় বর্গাচাষিদের বড় একটি অংশ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। পুলিশ দিয়ে জোর করে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। একাধিক ভুয়া চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে কৃষকদের এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। নদী দখল করে রাস্তা তৈরি করায় জলাবদ্ধতা বেড়েছে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সৌর তথা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হওয়া যাবে না। সরকারকে এ খাত থেকে রাজস্ব আহরণ পরিহার করতে হবে।
আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুতের দাম জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে। সৌরবিদ্যুতের দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং এ খাতে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারি খাতে সিস্টেম লস আর বেসরকারি খাতে অতি মুনাফা করার প্রবণতার বিচার হতে হবে। জ্বালানি খাতে অপরাধের বিচার করার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
জ্বালানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, জ্বালানিসংকট সমাধানে মৌলিক জায়গায় নজর দিতে হবে। ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের মাটির নিচে অনেক সম্পদ আছে। আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থার পৃথক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত ৩২ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের মজুত রয়েছে। এ গ্যাস উত্তোলন করা গেলে কম দামে বিদ্যুৎ পেত সাধারণ মানুষ। অনুসন্ধানের জন্য এখন দেশে বছরে মাত্র একটি গ্যাস কূপ খনন করা হয়। বছরে পাঁচ–ছয়টি কূপ খনন করলে পাঁচ বছরের মধ্যে গ্যাস জ্বালানির অভাব থাকবে না দেশে। দেশে গ্যাস নেই, গ্যাস নেই বলে যে তথ্য ছড়ানো হচ্ছে তা বিভ্রান্তিকর।
অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি খাত হতে হবে সেবাভিত্তিক। এটাকে বাণিজ্যিক খাত করা ভয়াবহ বিষয়। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে তা বিক্রি করেও দিচ্ছে। এখন জনগণ যে বিদ্যুৎ–সুবিধা পাচ্ছে, তা টেকসই নয়। অতীতে বিদ্যুৎ নিয়ে যে সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে, আগামী বছর পরিস্থিতি তার চেয়ে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশের গ্যাস–সম্পদকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয়েছে। গত এক দশকে সরকার আমদানিনির্ভর জ্বালানি মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুসারে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেছে। এই বিপুল পরিমাণ কয়লা ও এলএনজি আমদানি হলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরও পড়বে। এ ছাড়া অস্বাভাবিক হারে (৮০ শতাংশের ওপর) ঋণ নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর জন্য। ঋণ পরিশোধ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
সভায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া। সভা সঞ্চালনা করেন ক্যাবের সমন্বয়ক (গবেষণা) শুভ কিবরিয়া।