১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রায় অর্ধেকই খরচ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই কিনতে

সারা দেশের বেসরকারি পাঠাগারের জন্য কেনা বইয়ের তালিকা (২০২৩–২৪ অর্থবছর) থেকে ৭৯টি বই বাতিল করেছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এর ৪৯টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা। বাকিগুলোর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে। আর সর্বশেষ তিন অর্থবছরে বইয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ১০ কোটি টাকার প্রায় অর্ধেকই খরচ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে লেখা বই কিনতে।

বাতিল হওয়া ৭৯ বইয়ের প্রায় ৮ হাজার কপি এখন রাখা আছে গ্রন্থকেন্দ্রের গুদামে। এসব বই নিয়ে কী করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি পাঠাগারে দেওয়ার জন্য এসব বই কেনা হলেও জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে তা বিতরণ করার সুযোগ পায়নি গ্রন্থকেন্দ্র।

জনগণের অর্থে কেনা এসব বইয়ের (বাতিল করা বই) পরিণতি কী, সে সম্পর্কে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। সংখ্যা বা টাকার অঙ্কের চেয়ে বড় সমস্যা, পাঠকের মননশীলতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। মানুষকে কী পড়ানো হবে, এটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত; যা এখান থেকে নেওয়া হয়েছে।
—আফসানা বেগম, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক

বাতিল হওয়া বইয়ের কয়েকটির শিরোনাম, ‘পাটশিল্প: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’, ‘অক্ষরস্রোতে বঙ্গবন্ধু’, ‘কিশোর গল্পে বঙ্গবন্ধু’, ‘শেখ ফজলুল হক মণি’র রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন’, ‘রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা’, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’।

বাতিল হওয়া বইয়ের তালিকা থেকে দেখা যায়, একই প্রকাশনের পাঁচটি করে বইও আছে সেখানে। এর কোনো কোনোটির মূল্য এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। বইগুলো কেনা হয়েছে এক শ’ থেকে দেড় শ’ কপি করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেসরকারি পাঠাগারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে মোট ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু বই কেনায় বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা; বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলো কেনা হয়েছে এ টাকারই অর্ধেক দিয়ে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরের জন্য কেনা বইয়ের তালিকা থেকে ৭৯টি বই বাতিল হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।

বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে এক বিষয়ের বই। বাতিল করতে হয়েছে ৭৯ শিরোনামের বই। যা এখন রাখা আছে গ্রন্থকেন্দ্রের একটি কক্ষে। ১১ নভেম্বর দুপুরে তোলা ছবি
ছবি: সংগৃহীত

গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিবছর এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা–উপজেলার বেসরকারি পাঠাগারগুলোয় বই দিয়ে থাকে। সারা দেশে ১ হাজার ৩০০–এর বেশি বেসরকারি পাঠাগার আছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৭৫০ পাঠাগার বই পায় বছরে একবার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রন্থকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ২০২১–২২ অর্থবছর থেকে সিদ্ধান্ত হয়, গ্রন্থকেন্দ্র বিভিন্ন পাঠাগারের জন্য যেসব বই কিনবে, তার ৪০ শতাংশই হবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। এর বাইরেও বিভিন্ন পক্ষের অনুরোধে তালিকায় একই বিষয়ের বই রাখা হয়। ফলে কমিটি থাকলেও বই নির্বাচন হয় তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে। এগুলো হলো বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রকাশকের সঙ্গে সম্পর্ক। দেখা যায়, মোট বইয়ের অর্ধেকের বেশি কেনা হয় একই প্রসঙ্গে। আর দেশের বিভিন্ন স্থানের পাঠাগারের গ্রন্থাগারিকেরা বাধ্য হন সেসব বই নিতে।

১২ নভেম্বর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে বই নিতে নড়াইল থেকে এসেছিলেন শতবর্ষী রামনারায়ণ গণগ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক কাজী গোলাম মোস্তফা। এক দশক ধরে তিনি এ প্রতিষ্ঠান থেকে বই নিচ্ছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন ‘কখনোই আমাদের কাছ থেকে বইয়ের তালিকা নেওয়া হয় না। এতে গ্রন্থকেন্দ্রের দেওয়া বইয়ের সঙ্গে স্থানীয় পাঠকের পাঠরুচি মেলে না। অন্তত ৫০টি বই পেয়েছি শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। মোট বইয়ের ২০ শতাংশের বেশি মুক্তিযুদ্ধের বই। এখন আর পাঠক এসব বই বারবার পড়তে চায় না। অচেনা লেখকের বই বেশি দেওয়া হয়। পাঠক এখনো বেশি খোঁজে রবীন্দ্র, নজরুল ও হুমায়ূন আহমেদের বই।’

জানা গেছে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৯১২টি শিরোনামের ৩ কোটি ১৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকার বই কেনা হয়। এর মধ্যে বিষয়বস্তুর বাইরে ও মানহীন হওয়ার কারণে বিতরণ করা যাচ্ছে না ৩৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকার ৭৯টি শিরোনামের বই।

হয়েছে বই–বাণিজ্যও

বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি সাঈদ বারী প্রথম আলোকে বলেন ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এ তোড়জোড় হয়েছে। তবে ১৫ বছর ধরেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলেই বই কিনেছে। এ জন্য নতুন নতুন প্রকাশনীও তৈরি হয়েছে। ঘুরেফিরে ১২ থেকে ১৫টি প্রকাশনী গুরুত্ব পেয়েছে সে তালিকায়। এভাবে চলেছে বই–বাণিজ্য।’

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিচালক হিসেবে উপসচিব মো. শওকত আলীর যোগদান এবং ১ মাস ২৭ দিনের মাথায় তাঁকে আবার পরিবর্তন করা, গ্রন্থকেন্দ্রের বই–বাণিজ্যের একটি উদাহরণ। ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি শওকত আলী যোগদান করে সেদিনই বই কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। নির্দিষ্ট প্রকাশনীর রবীন্দ্র রচনাবলি কেনা ছিল দরপত্রের উদ্দেশ্য। দরপত্র আহ্বান করে রচনাবলি কেনার কাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বছরের ২৯ মার্চ তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় পদ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানালেন এ তথ্য। গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালকের নাম ও মেয়াদের তালিকার সঙ্গে বই কেনার তথ্য মিলিয়ে দেখা গেল ঘটনা তা–ই।

গ্রন্থকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে সিদ্ধান্ত হয়, গ্রন্থকেন্দ্র বিভিন্ন পাঠাগারের জন্য যেসব বই কিনবে, তার ৪০ শতাংশই হবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। এর বাইরেও বিভিন্ন পক্ষের অনুরোধে তালিকায় একই বিষয়ের বই রাখা হয়। ফলে কমিটি থাকলেও বই নির্বাচন হয় তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর গুরুতর বিষয় বিবেচনায় ৭৯টি বই বাতিল করতে হয়েছে। তবে বইয়ের বিষয়, কাগজ, ছাপার মান বিবেচনা করলে নয় শর মধ্যে ছয় শতাধিক বই–ই বাদ দিতে হতো। মন্ত্রী ও সচিবের ছিল ২০ শতাংশ কোটা। নিয়ম হয়েছিল ৪০ শতাংশ বই কেনা হবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। ফলে মোট বইয়ের ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে যেত একই বিষয়ের বই।’

আফসানা বেগম আরও বলেন, বাতিল করা বই রাখা আছে গ্রন্থাগারের একটি কক্ষে। তবে জনগণের অর্থে কেনা এসব বইয়ের পরিণতি কী, সে সম্পর্কে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। সংখ্যা বা টাকার অঙ্কের চেয়ে বড় সমস্যা, পাঠকের মননশীলতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। মানুষকে কী পড়ানো হবে, এটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত; যা এখান থেকে নেওয়া হয়েছে।