ঢাকায় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোটের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ যোগ দেবেন বলে কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি।
আইওআরএর বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২২ সালের নভেম্বরে। তখন সের্গেই লাভরভের সফরের কথা শুনে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ, রাশিয়ার ক্ষমতার পরিমণ্ডলে লাভরভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়া যুদ্ধে জড়ানোর পর বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দায়িত্বটা তাঁর কাঁধে।
ওদিকে রাশিয়া তখন সবে আইওআরএর পর্যবেক্ষক হয়েছে। এরপরই মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে সের্গেই লাভরভের বাংলাদেশ আসার বিষয়টি ঠিক হয়েছিল, যা অনেককে অবাক করেছিল।
সেবার ঢাকা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সের্গেই লাভরভের সৌজন্য সাক্ষাতের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে লাভরভের ঢাকা সফর বাতিল করে মস্কো।
সফরটি বাতিলের পর থেকেই রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। সের্গেই লাভরভ যে ঢাকায় আসতে চান, সেটি তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সফর বাতিলের পর ফোন করে নিশ্চিত করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে জাকার্তা থেকে ঢাকায় আসছেন লাভরভ। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। পরদিন অর্থাৎ ৮ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। ওই দিন বিকেলে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে দিল্লির পথে ঢাকা ছাড়বেন লাভরভ।
পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধুত্ব ঝালাইয়ের পাশাপাশি নতুন বন্ধু খোঁজাও রাশিয়ার অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে স্বাভাবিকভাবেই পাশে চাইবে তারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও গত ৩০ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেছেন, সের্গেই লাভরভ ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসবেন। তিনি ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মিত্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী বাংলাদেশে আসেননি। গ্লাসনস্ত (উদার সমাজ গঠন) ও পেরেস্ত্রোইকার (অর্থনৈতিক পুনর্গঠন) পথে গিয়ে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পরও ঢাকা-মস্কো সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। সেই বিবেচনায় সের্গেই লাভরভের সফরটিই হবে রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর পশ্চিমা চাপে কোণঠাসা রাশিয়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়টি জোর দিচ্ছে। পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধুত্ব ঝালাইয়ের পাশাপাশি নতুন বন্ধু খোঁজাও রাশিয়ার অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে স্বাভাবিকভাবেই পাশে চাইবে তারা।
অবশ্য ঢাকাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘দ্বৈরথের ক্ষেত্র’ বানানোর নেপথ্যে ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য খালাস করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছে রাশিয়া।
চিরাচরিতভাবে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নীরব রাশিয়া বছরখানেক ধরে বাংলাদেশের বিষয়ে নিজেদের সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে আসছে। সেটি ঢাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মস্কোর নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছে দেশটি।
দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে রাশিয়ার এই খোলস ছেড়ে বের হওয়ার নেপথ্যে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ, সেটি রাশিয়া মোটেও গোপন করছে না। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিবিদদের ভূমিকাকে নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে রাশিয়া। মস্কো মনে করে, এ ধরনের পদক্ষেপ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’।
অবশ্য ঢাকাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘দ্বৈরথের ক্ষেত্র’ বানানোর নেপথ্যে ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য খালাস করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছে রাশিয়া। রুশ জাহাজটির নাম ছিল ‘স্পার্টা-৩’। সেটি পরিবর্তন করে ‘উরসা মেজর’ নাম দিয়ে রাশিয়া রূপপুর প্রকল্পের পণ্য পরিবহন করছিল।
কিন্তু ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে কূটনৈতিক পত্র দেওয়ার পর বাংলাদেশ উরসা মেজরকে এ দেশের জলসীমায় ঢুকতে দেয়নি। পরে তৃতীয় দেশে গিয়ে রাশিয়া ওই পণ্য খালাস করতে বাধ্য হয়েছে। ঘটনাটি গত ডিসেম্বরের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের একাধিক কূটনীতিক প্রথম আলোকে এই আভাস দিয়েছেন যে সের্গেই লাভরভ ঢাকায় যে দুটি আলোচনায় বসবেন, সেখানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজকে কেন প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো না, সেটি তুলতে পারেন।
খসড়া সফরসূচি
ঢাকা ও মস্কোর কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনা শেষে সের্গেই লাভরভের ঢাকার সফরসূচি মোটামুটি চূড়ান্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত সবশেষ আলোচনা অনুযায়ী, ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে জাকার্তা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছাবেন লাভরভ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ওই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে প্রথমে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর নৈশভোজ। সেখানে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামসহ আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তাঁরা।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৮ সেপ্টেম্বর সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। বিকেলে ঢাকা ছাড়ার আগে তিনি রাজধানীর একটি হোটেলে সাবেক সোভিয়েত আমলে বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী রাশিয়ায় গিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগ দেবেন।
আলোচনায় যা থাকছে
সের্গেই লাভরভ যখন ঢাকায় আসবেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মস্কোর দিক থেকে আলোচনার আভাস মিলেছে।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ঢাকা-মস্কো সম্পর্ক জোরদার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের প্রসঙ্গগুলো আসবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সইয়ের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ২০টির মতো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সইয়ের অপেক্ষায় থাকা ২০টির মতো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে অন্তত চারটি চুক্তি প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত। এর মধ্যে রয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গোপনীয় তথ্য বিনিময়, প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কারিগরি বিষয়ে মেধাস্বত্ব অধিকার, প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের প্রশিক্ষণ।
জানা গেছে, দুই দেশ বন্দী প্রত্যর্পণ, কারাবন্দীদের হস্তান্তর, মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারসহ অন্তত ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সইয়ের জন্য নানা স্তরে রয়েছে।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় লাভরভের সফরটি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে বৈশ্বিকভাবে রাশিয়ার প্রভাব এবং গুরুত্ব দুটিই কমেছে। আবার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়া। পশ্চিমাদের চাপের মুখে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে বাংলাদেশ কীভাবে তুলে ধরে, সেটিও দেখার বিষয়।