দেশে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে ৩৭% কিশোরী ও নারী
শিশু, কিশোরী ও অন্তঃসত্ত্বা নারীর পুষ্টি বিষয়কে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে অপুষ্টির কারণে দেশের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি প্রতিরোধ করা যায়। কারণ, অপুষ্টির দুষ্টচক্রের কারণে দেশে এখনো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৬ শতাংশের বেশি খর্বকায়, ২৩ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে, ৪৩ শতাংশ শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩৭ শতাংশ কিশোরী ও নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। আজ বুধবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরে পুষ্টি খাতে বহুখাতমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়।
রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ: প্রয়োজনীয়তা, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শিরোনামে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক মনোজ কুমার, সংস্থার এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপক জিজ্ঞাসা নাওয়ানি, বাংলাদেশের পরিচালক (কান্ট্রি ডিরেক্টর) সায়কা সিরাজ ও ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর আসফিয়া আজিম।
সভায় বলা হয়, দেশে শৈশবকালীন অপুষ্টি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে। গত এক দশকে পুষ্টি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও খর্বকায় ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে বাংলাদেশ। প্রজননক্ষম কিশোরী ও নারীদের ৩৭ শতাংশ রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। কিশোরী মেয়েদের গর্ভধারণের হারের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। প্রতি হাজারে ১১৩ জন কিশোরী ১৯ বছর বয়সের আগে মা হচ্ছে। এসব বিষয় দেশে অপুষ্টিজনিত বড় বোঝা তৈরি করছে।
নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিশু, কিশোরী ও নারীদের মধ্যে খর্বকায় ও রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ বাড়ালে বাংলাদেশ কমপক্ষে ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার (১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি) বাঁচাতে পারে, যা দেশের মোট দেশজ আয়ের (জিএনআই) ২ দশমিক ৮ শতাংশ। পুষ্টি শুধু স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে না, এটা অর্থনৈতিক উৎপাদন, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নেও প্রভাব ফেলে। তাই পুষ্টির বিষয়টি অন্যান্য খাতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কৈশোরকালীন পুষ্টি কার্যক্রমের আওতায় স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীদের আয়রন ফলিক অ্যাসিড (আইএফএ) ট্যাবলেট বিতরণের জন্য এ খাতে আলাদা বরাদ্দ রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও প্রসূতিদের জন্য কেনা আইএফএ ট্যাবলেট থেকে কিশোরীদের এই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় চলা এই কার্যক্রমে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় বেশির ভাগ মাধ্যমিক স্কুলে আইএফএ ট্যাবলেট বিতরণ বন্ধ রয়েছ। গত জুন মাসে চতুর্থ এইচএনএসপির মেয়াদ শেষ হয়। পঞ্চম এইচএনএসপি এখনো শুরু করতে পারেনি সরকার।
নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক মনোজ কুমার বলেন, মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি, জ্ঞানীয় বিকাশ ও সার্বিক উন্নয়নের ভিত্তি হলো পুষ্টি। পুষ্টি খাত রাজনৈতিক অগ্রাধিকারে থাকা উচিত। পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ করলে ফেরত আসবে অনেক বেশি হারে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও পুষ্টি নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় থাকতে হবে।
সংস্থার এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপক জিজ্ঞাসা নাওয়ানি বলেন, অপুষ্টিজনিত ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে বারবার আলোচনা করা উচিত। তাহলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আসবে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে আনলে পরিবর্তন আসবে।
পুষ্টি খাতে সরকারের কাঠামোকে শক্তিশালী করতে না পারলে দাতা সংস্থা কোটি কোটি টাকা ঢাললেও পুষ্টি অবস্থার উন্নতি হবে না বলে মন্তব্য করেন নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সায়কা সিরাজ। তিনি বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য এবং খাদ্য—এই খাতগুলোতে পুষ্টির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নজর বাড়ানো দরকার। তা না হলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে ‘পুষ্টি’ শুধু শব্দ হিসেবে থেকে যাবে। তিনি আরও বলেন, পুষ্টিকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বহুখাতমুখী পদক্ষেপ নিলে রক্তস্বল্পতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে পুষ্টিবান্ধব করা দরকার। শহরের দরিদ্রদের জন্য সরকারের স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিসেবা দুর্বল। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে তাদের কার্যক্রমগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর আসফিয়া আজিম বলেন, অপুষ্টি প্রতিরোধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বল্পকালীন কার্যক্রমেও জোর দিতে হবে। দুর্যোগের সময়ে শিশু অপুষ্টি প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদিত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাউডার খাবারের ওপর ছিটিয়ে খাওয়ালে শিশুর অপুষ্টির ঘাটতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়।