খাদ্যপণ্যের দাম
আমনের উৎপাদন বেশি, তবু চড়া চালের বাজার
চালকলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার কারণে ভরা মৌসুমেও দাম কমছে না।
আমন ধান কাটা শেষ। এ বছর বেড়েছে উৎপাদনও। শুরু হয়েছে বোরো মৌসুম। সাধারণত ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম কমতে থাকে। কিন্তু বর্তমানে চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। মোটা চালের কেজি ৫২ টাকায় (ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে) স্থির আছে, যা গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেশি। অপর দিকে, দেশের মানুষের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য আটার দামও বেড়েছে।
১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ থেকে প্রকাশ করা বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের বাজারদরবিষয়ক পাক্ষিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, প্রতি কেজি মোটা চাল উৎপাদনে খরচ ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অন্য সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫২ টাকা। কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সাধারণত উৎপাদন খরচ থেকে ভোক্তাপর্যায়ে দামের পার্থক্য তিন থেকে পাঁচ টাকা হয়। বাড়তি মুনাফার বড় অংশটি চালকলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীর পকেটে যাচ্ছে। এ মুনাফাকে অস্বাভাবিক বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, চালকলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের এ অতি মুনাফার কারণে ভরা মৌসুমেও দাম কমছে না।
চালের দাম বেশি থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর নিম্ন আয়ের প্রায় তিন কোটি মানুষ। তাঁদের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সরবরাহ বাড়ানো উচিত।সাত্তার মন্ডল, ইমেরিটাস অধ্যাপক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চেম্বার
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও কৃষক ধান বিক্রি করে কিছুটা লাভ করছেন। কিন্তু চালকলমালিকেরা অস্বাভাবিক বেশি মুনাফা বা সুপার নরমাল প্রফিট করছেন। যে কারণে চালের দাম কমানো যাচ্ছে না। এতে দেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে পুষ্টিহীনতার সমস্যা। কারণ, চালের দাম বেশি থাকায় তাঁরা পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
উৎপাদন বেশি, খরচও বেড়েছে
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, গত বোরো ও আউশ মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছিল। তাই সরকার আমন মৌসুমের জন্য চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৬১ লাখ টন নির্ধারণ করে। কিন্তু অনুকূল আবহাওয়া থাকায় এবার আমনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ লাখ টন বেশি অর্থাৎ ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। দেশে যে পরিমাণে চাল আছে, তাতে আগামী জুন পর্যন্ত কোনো সংকট হবে না, বরং ৪৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।
ব্রির হিসাবে, এবার আমনে গত বছরের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১০ শতাংশ। আর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, খরচ বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এতে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ২৫ টাকা এবং চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকা।
ব্রির মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দেশে চালের কোনো সংকট নেই। আমন উৎপাদন যথেষ্ট ভালো হয়েছে। উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও চালের দাম এখন যা আছে, তার চেয়ে আরও কম থাকার কথা। তিনিও দাম না কমার জন্য চালকলমালিক ও চালের খুচরা ব্যবসায়ীদের দায়ী করেন।
অপর দিকে, ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চালের দাম না কমার কারণ হিসেবে গত আমনের সময় ইউরিয়া সার ও ডিজেলের মতো কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, এতে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে ধানের দামও বেশি। এর ফলাফল হিসেবে চালের দাম কমছে না।
সরকার বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে চাল আমদানির জন্য শুল্ক কমিয়েছে। সরকারিভাবে আরও চার লাখ টন চাল আমদানি করছে। তাতেও চালের বাজারে কোনো প্রভাব না পড়ার কারণ হিসেবে দেশের বাজারে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং চালের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।
এদিকে টিসিবির হিসাবে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ ধরে একই রকম আছে। অন্যদিকে মাঝারি মানের চালের দাম বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা হয়েছে। সরু চালের কেজি ৫৮ থেকে ৭৫ টাকায় স্থির আছে।
মজুতও বেশি
ইউএসডিএর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি গুদামে গমের মজুত ৩ লাখ ৬৬ হাজার টন। আর চালের মজুত ১৫ লাখ ২০ হাজার টন। বিদেশ থেকে প্রায় ৪ লাখ টন চাল দেশে আসায় ওই মজুত বেড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর সরকার আমন মৌসুমে পাঁচ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টন চাল ও প্রায় তিন হাজার টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবার বোরো মৌসুমে ৪৯ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ওই জমিতে ২ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হতে পারে। চলতি জানুয়ারিতে বোরো ধান রোপণ শুরু হয়েছে। আগামী এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে তা কাটা শুরু হবে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, গম রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে গমের আমদানি কমে গেছে। যে কারণে আটার দাম দ্রুত বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে আটার দাম কেজিতে ৩ শতাংশ বেড়েছে। সাধারণ আটা প্রতি কেজি ৬২ টাকা এবং ভালো মানের আটা ৭২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে প্যাকেট আটার দাম ৬ শতাংশ কমে ৮০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।
বাড়তি মুনাফা যৌক্তিক কি না
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সাত্তার মন্ডল প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম বেশি থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর নিম্ন আয়ের প্রায় তিন কোটি মানুষ। তাঁদের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সরবরাহ বাড়ানো উচিত। তবে চালের দাম বেশি থাকায় যে বাড়তি মুনাফা হচ্ছে, তা কার পকেটে কত যাচ্ছে, তা যৌক্তিক কি না, সেটা আরও বেশি করে খতিয়ে দেখা দরকার।