‘দায়মুক্তি আইন’ বাতিলসহ বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে চার সংস্কার চায় সিপিডি

‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কার: সিপিডির প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। ধানমন্ডি, ঢাকা, ১৮ আগস্টছবি: আশরাফুল আলম

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্রুত চার সংস্কার চায় বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ অবিলম্বে বাতিল করা। এ আইনের অধীন নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তাই এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। গত ১৪ বছরে দরপত্র ছাড়া বিভিন্ন চুক্তি করা হয়েছে এ আইনে।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে আজ রোববার আয়োজিত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কার: সিপিডির প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। সিপিডি যেসব বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চায়, তার মধ্যে আরও আছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা তৈরি, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন সংশোধন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা তৈরি।

সংবাদ সম্মেলনে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কার: অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিবেচ্য বিষয়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, দুর্নীতির চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে বিভিন্ন নীতি। দেড় থেকে দুই গুণ বেশি চাহিদা হিসাব করে প্রক্ষেপণ তৈরি করা হয়েছে। এমন নীতি তৈরিই করা হয়েছে একটা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে। নীতি ও আইন খাতে ১৭টি সংস্কার দরকার।

সিপিডির নিবন্ধ বলছে, প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল। গত সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছানো অন্যতম। তবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে খরচের বোঝা কমত। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার দরকার।

সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপে ছয় মাস, এক বছর ও তিন বছরের রূপরেখা তৈরি করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে শুরুতেই ১০০ দিনের একটি কর্মপরিকল্পনা হাজির করতে পারেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উপদেষ্টা। দ্রুত সংস্কারের বিষয়গুলো এ সময়ের মধ্যে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া স্বাধীন কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ খাতে ভুতুড়ে বিল তদন্ত করতে হবে প্রথম ছয় মাসেই।

বৈশ্বিক সহযোগিতার নতুন সমীকরণ

সিপিডি বলছে, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। কোনো আন্তর্জাতিক চাপে যেন আবার দেশি কয়লা উত্তোলনে জোর দেওয়া না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। তবে এটা যেন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিভিত্তিক না হয়। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে তারা আসতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত সূচনা হতে পারে। ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলমান থাকবে। চীনের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হবে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এএফবির মতো বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থার সঙ্গে ব্যাপক অংশীদারত্ব তৈরি হতে পারে।

নিবন্ধে বলা হয়, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সংস্কার করা দরকার। এর মধ্যে আছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে ধীরে ধীরে। আইন সংশোধন করে কমিশনকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এটিকে যুগোপযোগী করে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা দরকার। বিপিসি ও পিডিবি থেকে নিয়মিত তথ্য পাওয়া যায় না। তথ্য নিয়মিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। বিপিসির স্বয়ংক্রিয় দাম নির্ধারণপ্রক্রিয়া ত্রুটিযুক্ত। এখানে মুনাফা দেখা হয়েছে, ভোক্তাস্বার্থ দেখা হয়নি। গত পাঁচ বছরে বিপিসি ও পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সংস্থা দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাতিল করতে হবে

সিপিডি বলছে, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮ অনুসরণ করতে হবে। তবে এটি যাতে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ না হয়। দীর্ঘসূত্রতা কমানোর নামেই বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়েছিল এ খাতে। এটি শুরুর দিকে হয়তো দরকার ছিল। কিন্তু পরে বাতিল না করে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ আইন এখন বাতিল করে দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

নিবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪১ শতাংশ বেশি আছে। বর্তমানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে, তা দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করা যাবে। এর মধ্যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর নবায়ন না করা। এ সময়ে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়ন করা না হলে ৩ হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট সক্ষমতা কমবে। এগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূরণ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যমান চুক্তি সংশোধন করে কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) বাতিল করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই শর্তে এটি করা যেতে পারে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও একই শর্তে চুক্তি করতে হবে। এতে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির চাপ কমে আসবে। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কেন্দ্রভাড়া বাতিল করা দরকার।

সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার লক্ষ্য সংশোধন করে ৩৫ হাজার মেগাওয়াট করা উচিত। এটি করা হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হবে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। তাহলে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। জাতীয় জ্বালানি নীতি ১৯৯৬ সালে তৈরি করা হয়েছে। এটা মানাও হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই নীতি আর উপযোগী নয়। নতুন করে জ্বালানি নীতি তৈরি করা দরকার। দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে হবে। নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো দরকার।