যমজ ভাই মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ আর মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। জন্মের পর ২৫ বছর ৯ মাস ১৪ দিন তাঁরা কমবেশি একসঙ্গে কাটিয়েছেন। পরের দিনটিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মুগ্ধ শহীদ হন।
আরেক যমজ আসিফ হাসান আর রাকিব হাসান। জীবনের প্রায় ২২টি বছর একসঙ্গে কাটিয়েছেন। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে মাহফুজুর রহমানের (মুগ্ধ) মতো আসিফও শহীদ হন।
জীবনে এবারই প্রথম যমজ ভাইকে ছাড়া ঈদ করলেন স্নিগ্ধ ও রাকিব। এই দুই পরিবারের সদস্যদের কষ্টটা যেন একটু বেশি; যমজ একজন চোখের সামনে থাকলেও আরেকজন নেই।
গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে গত বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর কপালে গুলি লাগে। স্বজনদের মধ্যে ভাই স্নিগ্ধ হাসপাতালে গিয়ে মুগ্ধর মরদেহ প্রথম দেখেন। ওই দিন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মানুষজনের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন মুগ্ধ। পানির কেস হাতে নিয়ে ‘কারও পানি লাগবে, পানি, পানি...’ বলছিলেন মুগ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ভাইরাল হয়।
মুগ্ধর আগে জন্ম স্নিগ্ধর। মুগ্ধর চোখের নিচে একটি ছোট তিল আর শারীরিক গড়নে একটু হালকা–পাতলা—এই পার্থক্য ছাড়া দুজনের চেহারায় ছিল দারুণ মিল।
মুগ্ধ ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে স্নাতক শেষ করেন। ঢাকায় ফিরে এমবিএ পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে আয়ও করতেন।
আসিফ হাসান ঠিক কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সে রকম কোনো ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তবে আসিফের বন্ধুদের কাছ থেকে গুলি ও ছররা গুলিতে বুক ঝাঁজরা হয়ে গেছে—এমন ছবি পেয়েছেন তাঁর ভাই রাকিব হাসান। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের মধ্যে মুগ্ধ যেমন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, আসিফ যেন ততটাই সবার চোখের আড়ালে।
আসিফের জন্ম আগে, রাকিবের পরে। দুজনের চেহারায় এত মিল যে কে কোনজন, তা চেনা ছিল মুশকিল।
মুগ্ধর মতো আসিফও গত বছরের ১৮ জুলাই উত্তরায় গুলিতে নিহত হন। ওই দিন উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। আসিফ রাজধানীর নর্দান ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।
ঈদে মুগ্ধর প্রিয় খাবার রান্না করেননি মা
স্নিগ্ধ এবারের ঈদ নিয়ে নিজের মনের কথাগুলো ফেসবুকে লিখেছেন ঈদের আগের দিন। তিনি লিখেছেন, জীবনের ২৫টি ঈদ এই পৃথিবীতে তাঁরা একসঙ্গে কাটিয়েছেন। মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় ধরলে আরও এক বছর। এই ভাই এখন অনেক দূরে। মায়ের পেটে একসঙ্গে হওয়ার পর থেকে এটিই মুগ্ধকে ছাড়া প্রথম ঈদ। মায়ের কাছে শুনেছেন, জন্মের পর তাঁরা দুই ভাই জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতেন।
স্নিগ্ধ আরও লিখেছেন, ‘তবে ও (মুগ্ধ) মারা যাওয়ার পর ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। যতক্ষণ সম্ভব জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি, তারপরেও কেন যেন এখনো আফসোস হয়, কেন আরেকটু জড়ায় ধরে থাকলাম না? প্রতি ঈদে সবার সাথে কোলাকুলি করে ঈদ মোবারক বলা হলেও মুগ্ধর সাথে ওই ইগোর জন্য করা হতো না। “মনে মনে ভাবতাম, আরে ধুর মুগ্ধই তো।" এখন আফসোস হয়, কেন প্রতিটা ঈদে কোলাকুলি করে ঈদ মোবারক বললাম না। আর তো এই সুযোগ পাব না, কখনোই পাব না। হয়তো পাব, তবে সেটি মৃত্যুর পর।’
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সহায়তার পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি ধরে রাখতে গঠিত জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্নিগ্ধ। তিনি এবারের ঈদে পরিবারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন। মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
কথা হয় স্নিগ্ধ ও মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমানের (দীপ্ত) সঙ্গে। স্নিগ্ধ–মুগ্ধর জন্মের সময় এই ভাইয়ের বয়স ছিল ছয় বছর। তিন ভাই ছিলেন বন্ধুর মতো।
মীর মাহমুদুর রহমান জানালেন, মুগ্ধ ও দাদা–দাদির কবর জিয়ারত করার মধ্য দিয়ে এবারের ঈদ শুরু হয়েছে তাঁদের। এবার ঈদে স্নিগ্ধ নতুন কোনো পাঞ্জাবি কেনেননি, শেষবার ঈদের দিন মুগ্ধ যে পাঞ্জাবি পরেছিলেন, সেই পাঞ্জাবি পরেই স্নিগ্ধ ভাইয়ের কবর জিয়ারত করেন।
উত্তরায় কামারপাড়া (বামনারটেক) কবরস্থানে মুগ্ধর কবরের পাশেই আরেক শহীদ টঙ্গী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদের কবর। অভ্যুত্থানের সময় ১৯ জুলাই রিয়াদ উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ২৭ নম্বর রোডে গুলিতে শহীদ হন। স্নিগ্ধ ফেসবুকে এই দুই শহীদের কবর জিয়ারতের পাশাপাশি অন্যান্য শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানান।
মীর মাহমুদুর রহমান বলেন, ঈদ মানে পরিবারের সবাই একসঙ্গে হয়ে আনন্দ করা। এবার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য নেই। বাবার সঙ্গে তিন ভাইয়ের নামাজে যাওয়া, বাবার সঙ্গে কোলাকুলি করা, নামাজ থেকে ফিরে মুগ্ধর মায়ের হাতের প্রিয় খাবার পুডিংসহ অন্যান্য খাবার না পেলে অভিমান করা, আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া, বিকেলে তিন ভাই ও বন্ধুরা মিলে বাইক নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া—এবার এসবের কিছুই হয়নি। মুগ্ধ নেই বলে মা শাহানা চৌধুরী ঈদের দিন কোনো রান্নাই করেননি। মাহমুদুর রহমান জানালেন, তাঁদের মা বিকেলে ছেলের কবরের কাছে গিয়েছিলেন। মায়ের মনে হয়েছে, মুগ্ধ মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, মা তুমি এত দিন পরে এসেছ? আর সারা দিনই পরিবারের সদস্যরা স্মৃতিচারণা করেছেন—মুগ্ধ থাকলে এখন এই করত বা ওই করত।
রাকিবের কাছে ঈদের দিন বলে বাড়তি কিছু মনে হয়নি
যমজ মানেই অনেক স্মৃতি। এইচএসসি পর্যন্ত রাকিব আর আসিফ সাতক্ষীরার বাড়িতেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। রাকিব সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আসিফ এই কলেজে ভর্তি হলেও পরে তা বাতিল করে ঢাকায় নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এক মেসে। গত ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ দুই ভাই একসঙ্গে করেছিলেন। দুজন মিলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আত্মীয়দের বাড়ি গেছেন।
মুঠোফোনে রাকিব বলেন, ‘এবার ঈদের দিনকে ঈদের দিন বলেই মনে হয়নি। ভাইকে ছাড়া প্রথম ঈদ। তাই অন্যান্য দিনের মতোই মনে হয়েছে। বাড়ির পাশেই আসিফের কবর। এবার আসিফের বন্ধুসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা কবর জিয়ারত করতে এসেছেন। আমাদের খোঁজ নিয়েছেন।’
রাকিব বলেন, আসিফ সব সময় হাসিখুশি থাকতেন। মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন, তাই তাঁর পরিচিত মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি ছিল। মেধাবী ছিলেন, অল্প পড়েই ভালো ফল করতেন। তবে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত দুই ভাইয়ের অনেক ঝগড়া হতো বলেও জানালেন রাকিব। তবে তার পর থেকে দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাব হয়ে গিয়েছিল।
রাকিব আক্ষেপ করে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমি সাতক্ষীরায় ছিলাম। ভাই আমাকে বারবার আন্দোলনে গেলে যাতে সাবধানে থাকি, তা বলেছে। আমি তো ধারণাও করতে পারিনি আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালাবে। আসিফের এক বন্ধু ফেসবুকে পোস্ট দিলে ছবি দেখেই বুঝতে পারি, আমার ভাইটা আর বেঁচে নেই। ভাইয়ের বন্ধুরাই ভাইকে হাসপাতালে নেয়, লাশ পাহারা দেয়। পরে তিন বোনের মধ্যে ঢাকায় থাকা আমার মেজ বোন, এক চাচাতো ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুরা মিলে লাশ বাড়িতে আনে।’
২০১৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় রাকিব আর আসিফের মা মারা যান। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা মাহমুদ আলম জমি ইজারা দিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়ে চলেন। লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করবে, আবার কষ্ট পাবে, বাবা তা সহ্য করতে পারবেন না; শুধু এ কারণে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি বলে জানালেন রাকিব। তবে তাঁরা এমন হত্যাকাণ্ডের বিচার চান।