পাকিস্তানিদের পরাজয় নির্ধারণ করে দেয় যে হামলা
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) হামলা চালায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। চারটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালানো হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিডি বকশি তাঁর ‘৭১ ড্যাশ টু ঢাকা’ বইয়ে এই হামলার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। কীভাবে একটি গোপন সংকেত উন্মোচনের মাধ্যমে ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউসে হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল, কীভাবে বিমান উড়ে গিয়ে হামলা করেছিল, কীভাবে এই হামলা পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন—বইয়ের ‘মূলে আঘাত: গভর্নর হাউসে হামলার আদ্যোপান্ত’ শীর্ষক অধ্যায়ে প্রাণবন্ত বর্ণনায় ছবির মতো উঠে এসেছে সবকিছু। ওই হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।
গোপন সংকেত উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত কর্মী উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। ভারতীয়রা পাকিস্তানের গোপন সংকেত উদ্ধার করেছে। ১৭তম ওয়্যারলেস এক্সপেরিমেন্টাল ইউনিটের হাবিলদার বিপিন ত্রিবেদির হাতে এখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হাউসের সেই সংকেত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় গভর্নর হাউসে জরুরি বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছে গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিক এই গোপন সংকেত পাঠিয়েছেন। বৈঠকে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন—পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি, মেজর জেনারেল ফরমান আলী, গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা এবং নিয়াজির নেতৃত্বাধীন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। মূলত ঢাকায় সেদিন গভর্নর হাউসে পাকিস্তানের পুরো মূল নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোলের (সিঅ্যান্ডসি) কর্মকর্তাদের এক ছাদের নিচে মিলিত হওয়ার কথা।
সংকেত হাতে পাওয়ার পর উত্তেজিত সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভাল্লা দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হন। ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি জেনারেল জ্যাকবের কাছে বার্তাটি পৌঁছে দেন। সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল জ্যাকব শিলংয়ে বিমানবাহিনীর ইস্টার্ন এয়ার কমান্ড সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (এসএএসও) এয়ার ভাইস মার্শাল দাভেশারকে ফোন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ প্রতিরক্ষাবিষয়ক তাত্ত্বিক জন ওয়াড্রেন (প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের মূল পরিকল্পনাকারী) গভর্নর হাউসে হামলাকে সুবর্ণ সুযোগ বলে উল্লেখ করেন। যুদ্ধের ময়দানে যা শত্রুপক্ষের ‘কেন্দ্রভাগে হামলা’ তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। সাধারণত দেখা যায়, সেনাবাহিনী ধাপে ধাপে শত্রুবাহিনীর সুরক্ষার বিভিন্ন স্তর ভেদ করে কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোলে পৌঁছায়। সরাসরি মূল কেন্দ্রে হামলা শত্রুপক্ষকে পুরোপুরি অসাড় ও অচল করে দেয়। ওয়াড্রেন মনে করতেন, ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া এবং বাইরে (সীমান্ত) থেকে রাজধানীর মূল কেন্দ্রে ঢুকে আক্রমণ করার প্রক্রিয়াটি অর্থহীন। তিনি সরাসরি মূল কেন্দ্রে আঘাতের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, শত্রুপক্ষের কেন্দ্রস্থলে সরাসরি হামলার মধ্য দিয়ে তাদের পুরোপুরি অচল করে দেওয়া যায়। এ ধরনের হামলার জন্য বিমানই সবচেয়ে সেরা সরঞ্জাম বলে মনে করেন তিনি।
এই তত্ত্বে সম্মতি জানান ওয়ার ভাইস মার্শাল দাভেশার। আরেকটি মাধ্যম থেকেও এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। মুক্তিবাহিনী তাদের সূত্রের কাছ থেকে এই বৈঠকের বিষয়ে তথ্য পেয়ে তা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’–কে জানিয়েছিল। তারা এ তথ্য ইন্দিরা গান্ধীকে জানায়। ইন্দিরা গান্ধী তা বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পিসি লালকে জানান। বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তর—দুই মাধ্যম থেকেই সদর দপ্তর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড গোপন তথ্যটি পায়। এরপর দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে তারা।
১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৫৫ মিনিট, ভারতীয় বিমানবাহিনী ২৮ স্কোয়াড্রনের অপারেশনস রুম
ভারতীয় বিমানবাহিনীর গোয়েন্দা দলের গ্রুপ ক্যাপ্টেন ওলেন রুদ্ধশ্বাসে ২৮ স্কোয়াড্রনের অপারেশনস কক্ষে ছুটে আসেন। তিনি জানান, বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে একটি জরুরি বার্তা এসেছে। ঢাকার সার্কিট হাউসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর একটি জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। আর এ বৈঠক চলার সময়ই হামলা চালাতে হবে।
বৈঠকের সময় কখন? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন উইং কমান্ডার (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল হন) বিষ্ণয়। জবাবে ওলেন বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে, বেলা ১১টার দিকে শুরু হবে।’
‘উইং কমান্ডার বিষ্ণয় তাঁর ঘড়ি দেখেন এবং হাঁপাতে থাকেন। প্রধান পরিচালন কর্মকর্তাকে (সিওও) জরুরিভাবে ফোন দিয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘ঢাকায় যেতে ২১ মিনিট লাগবে। আমাদের বিমানে গোলাবারুদ বোঝাই করতে হবে। চারটি মিগ-২১ বিমানে ৩২টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (এইচই) রকেট বোঝাই করুন। প্রস্তুতি নিন। বিমান প্রস্তুত হলেই আমরা রওনা দেব।’
বিষ্ণয় ওলেনকে প্রশ্ন করেন, এই সার্কিট হাউসের অবস্থান কোথায়? ওলেন তখন ঢাকার একটি পর্যটক মানচিত্র বের করেন। সেখান থেকে তাঁরা সার্কিট হাউসের অবস্থান শনাক্ত করেন। ওলেন বলেন, ‘এটাই হবে।’
বিষ্ণয় জরুরিভাবে তাঁর পাইলটদের কী করতে হবে, তার সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দেন। তরুণ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বিনোদ ভাটিয়া, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রাঘভাচারি এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মালহি গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁর নির্দেশনা শোনেন।
বিষ্ণয় বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সব শীর্ষ কর্মকর্তাকে ঢাকার সার্কিট হাউসে একটি জরুরি বৈঠকে ডেকেছেন। চলুন, তাঁদের চূর্ণবিচূর্ণ করে দিই। এ বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই আমাদের সেখানে যেতে হবে।’
পাইলটরা তাঁদের বিমানের দিকে ছোটেন। চারটি মিগ-২১ বিমানের প্রতিটিতে ৩২টি করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেট বোঝাই করে এগুলো প্রস্তুত করা হয়। পাইলটরা বিমানের ককপিটে গিয়ে বসেন। উইং কমান্ডার বিষ্ণয় তাঁর ককপিটের ছাউনি মাত্রই বন্ধ করেছেন, এমন সময় একজন কর্মকর্তা তাঁর দিকে ছুটে আসেন। মই বেয়ে বিমানে উঠে হাতে লেখা একটি বার্তা দেন তিনি। সেখানে লেখা: লক্ষ্য সার্কিট হাউস নয়, গভর্নমেন্ট হাউস। আবারও বলছি—গভর্নমেন্ট হাউস।’
উইং কমান্ডার বিষ্ণয় বলে ওঠেন—‘শিট’!
দ্রুত বিষ্ণয় পর্যটক মানচিত্রটি দেখে গভর্নর হাউস শনাক্ত করেন। তিনি তখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। অন্য পাইলটদের রেডিওর মাধ্যমে বিষয়টি জানাবেন কি না, বুঝতে পারছিলেন না। এখনই এমনটা না করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কারণ, রেডিওর মাধ্যমে এখন বার্তা দিলে তা পুরো অঞ্চলে শোনা যাবে এবং শত্রুপক্ষ তা টের পেয়ে যেতে পারে। ঢাকায় পৌঁছানোর পরই তাদের বিষয়টি জানানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কারণ, সময় নষ্ট করার সুযোগ ছিল না। তিনি যাত্রা শুরু করেন। দ্রুতগতিতে বিমানটি চলতে শুরু করে। অন্য তিনটি যুদ্ধবিমানও তাঁকে অনুসরণ করে।
২১ মিনিট পর বিমানগুলো ঢাকার আকাশে পৌঁছে বাজপাখির মতো চক্কর দিতে থাকে। বিষ্ণয় নিচের দিকে তাকান এবং তাঁর মানচিত্রে গভর্নর হাউস শনাক্ত করেন। হামলার লক্ষ্য পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি তখন অন্য পাইলটদের জানান এবং স্থলভাগে এর অবস্থান শনাক্ত করতে বলেন। বিনোদ লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করেন।
টার্গেট বেলা ১১টা, ৫০০ মিটার—উচ্চ গম্বুজবিশিষ্ট ভবন
গাছের ওপরের উচ্চতায় নেমে এসে গভর্নর হাউস ভবনের কাছাকাছি তিনটি বিমান চক্কর দিতে থাকে। বিষ্ণয় তখন ঢাকার প্রধান সড়কের ওপর দিয়ে বিমান ওড়াচ্ছিলেন। বিমানটি এত নিচ দিয়ে যাচ্ছিল যে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে এটি দেখতে পাচ্ছিল। গভর্নর হাউসের বিশাল জানালা বরাবর তিনি অবস্থান নেন।
১২টা ১৫ মিনিট, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: গভর্নমেন্ট হাউস
গভর্নর হাউস ছিল একটি রাজকীয় ভবন। সম্মেলনকক্ষে বড় বড় এবং চকচকে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি ঝোলানো। সেখানে একটি মেহগনি কাঠের তৈরি গাঢ় বাদামি রঙের টেবিল ছিল। সেখানে ছিল কিছু চেয়ার। এগুলোর পেছনের অংশ ছিল অনেক উঁচু। গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিক বেশ উচ্চ রুচির মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ভবনের ভেতরের সাজসজ্জায় বিপুল অর্থ খরচ করেছিলেন। সেখানে লাগানো হয়েছিল জাঁকজমক ও আভিজাত্যের প্রতীক পর্দা। তবে সেখানকার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত বিষণ্ন ও থমথমে।
গভর্নর ভেতরে ঢোকার পর পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো হলো। জেনারেল নিয়াজি ইচ্ছা করে এক মিনিট দেরি করে ভেতরে ঢুকে দেখাতে চাইলেন, নেতা আসলে কে। গভর্নর মালিক তাঁর দিকে অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘জনাব কেয়ামত আ গ্যায়ি হ্যায় (আমাদের ওপর কেয়ামত নেমে আসছে)। আমি ঢাকার আমেরিকান কাউন্সেল জেনারেল পল মার্ককে ফোন করে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি এটা পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসকে জানিয়েছেন। তবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন।’
হতাশ গভর্নর মালিক নিয়াজির কাছে জানতে চান, ‘নিয়াজি সাহেব, এমনটা তিনি কেন করলেন? তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আরও বলেন, ‘উনকো হালাত কা পাতা নেহি? (এখানকার পরিস্থিতি কি তিনি জানেন না?) জনাব উনহে হুইস্কি পিনেসে ফুরসত মিলে তাব না’ (উনি হুইস্কি থেকে মুখ সরানোর সময় পেলে তো)। ভীষণ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বলেন গভর্নর মালিক। তিনি মনে করতেন, যা কিছু ঘটছে, তা সেনাবাহিনীর ভুলে ঘটছে।
নিয়াজি ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। রাগে তাঁর মুখ লাল হয়ে গেছে। গভর্নর মালিককে তিনি বলেন, ‘দেখিয়ে জনাব! জারা আদব সে বাত কারে (দয়া করে শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলুন)। ম্যায় জানতা হু হালাত খারাব হ্যায়, পার হাম ইস তারাহ টুট নেহি সাকতে (আমি জানি পরিস্থিতি খারাপ, তবে আমরা এভাবে ভেঙে পড়তে পারি না।’
সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যকার বিরোধ এখন প্রকাশ্য। সেনারা বেসামরিক প্রশাসনের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল।
‘টার্গেট ১১টা, ৩০০ মিটার। এনগেজ বে উইন্ডোজ, আমাকে অনুসরণ করুন।’
আরটিতে (রেডিও টেলিফোন) সাংকেতিক ভাষায় উইং কমান্ডার বিষ্ণয় অন্য পাইলটদের উদ্দেশে বললেন। তিনি দেখতে পান গভর্নর হাউস ভবনের কাছে সাদা ও সবুজ রঙের কিছু সেডান গাড়ি পার্ক করা আছে। তিনি বুঝতে পারেন বৈঠক তখনো চলছে।
এরপর বিষ্ণয় বলেন, ‘প্যানথার লিডার এখন ভেতরে ঢুকছে। আমাকে অনুসরণ করুন।’ বিষ্ণয় তখন ট্রিগার চাপলেন আর বুঝতে পারলেন রকেট যেভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়, তেমনি তাঁর বিমানও দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছে।
বিলাসবহুল ভবন থেকে যুদ্ধবিমানের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। জেনারেল নিয়াজি লাফিয়ে উঠলেন এবং বড় একটি জানালা দিয়ে তাকাতেই যুদ্ধবিমান দেখতে পেলেন। বিমান থেকে একসঙ্গে অনেক রকেট ছোড়া হচ্ছিল। এর পাখার নিচ দিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বুঝতে যুদ্ধে অভিজ্ঞ এ ব্যক্তির অসুবিধা হলো না।
জেনারেল নিয়াজির চোখে ভয়ের চিহ্ন। তড়িৎ টেবিলের নিচে ঢুকে তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘বিমান হামলা! বিমান হামলা!’
ওই কক্ষে উপস্থিত সবাই আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে অনুসরণ করে টেবিলের নিচে শুয়ে পড়েন। প্রচণ্ড শব্দে ওই রুমে ৩২টি রকেট আঘাত হানে। চারদিকে বিস্ফোরণের শব্দ। কক্ষের ঝাড়বাতিগুলো টেবিলের ওপর ভেঙে পড়ছিল। পুরো কক্ষ কাচের টুকরোয় ভরে গেছে। বিকট বিস্ফোরণে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কক্ষে থাকা ব্যক্তিদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাদের কান বন্ধ হয়ে গেছে। একে একে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ যুদ্ধবিমান থেকে ওই কক্ষে একের পর এক রকেট আঘাত হানতে থাকে।
সম্ভবত পরিস্থিতি বুঝতে জেনারেল নিয়াজি টেবিলের নিচ থেকে মাথা বের করেন। তিনি শব্দ শুনে বুঝতে পারেন মিগ-২১ বিমানগুলো দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে আসছে। বিমানের ইঞ্জিনের শব্দে জানালার কাচগুলো ঝনঝন আওয়াজ করছিল। বিকট শব্দে কান বন্ধ হয়ে আসছিল।
ওই কক্ষের দিকে ছুটে আসা রকেটগুলো বিস্ফোরিত হয়ে বড় বড় আগুনের গোলা তৈরি করছে। ওই আগুনে টেবিলের নিচে থাকা নিয়াজিসহ অন্য কমান্ডারদের চুল ঝলসে গেছে। কিছু সময়ের জন্য নিয়াজি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। তিনি বিস্ফোরণের ধাক্কা টের পাচ্ছিলেন। তাঁর মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। শব্দে তাঁর কান বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি খুব ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ, সাধারণত যুদ্ধবিমানগুলো একবার হামলা চালিয়ে পালিয়ে যায়। সাবরে যুদ্ধবিমানগুলো কোথায় গেল? সব কটি বসিয়ে রাখা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী রানওয়েকে নষ্ট করে দিয়েছে। ফিজা ইয়ার পাইলটরা তখন পাল্টা হামলার চেয়ে নিজেদের সামরিক শক্তিকে রক্ষায় বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন।
নিয়াজি ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবছিলেন, কেন এমন হচ্ছে? এমন সময় আবারও বিস্ফোরণ হয়। চারটি মিগ-২১ বিমান থেকে পুরোনো গভর্নর হাউসের ভেতরে ৩২টি রকেট ছোড়া হয়। আর ওই কক্ষের কাছ দিয়ে চলে যায় ১২৮টি রকেট। ভাগ্যক্রমে প্রতিটি রকেটই কক্ষের শেষ প্রান্তে আঘাত করেছে। এতে ওই অংশের দেয়াল এবং ছাদে গর্তের সৃষ্টি হয়।
নিয়াজি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং হতাশ হন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে তাদের ক্রমাগত সহযোগিতার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল—ইয়েলো ফ্রম দ্য নর্থ, হোয়াইটস ফ্রম দ্য সাউথ’ (উত্তর থেকে হলুদ, দক্ষিণ দিক থেকে সাদা আসছে)। এ ছিল খুব নিষ্ঠুর এক উপহাস।
নিয়াজির গাল বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। ক্রমাগত তাঁর চাপ বাড়ছিল। ওই দিনগুলোয় তিনি প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়তেন। তবে এদিনের কান্নার ধরন ছিল ভয়াবহ। ওই সময় যুদ্ধে চাপে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এমন বিশেষজ্ঞরা আমাদের বলেছেন, ‘ওই হামলার ঘটনা আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই হামলা নৈতিক মনোবলকে ভয়াবহভাবে শেষ করে দিয়েছে। কারণ, এ তো মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসা।’
কর্নেল সাদিক সালিক শুনতে পেলেন, নিয়াজি জোরে জোরে ফোঁপাচ্ছিলেন। তিনি জোরে জোরে গালি দিচ্ছিলেন, ‘পিন্ডি মে বেঠে হারামজাদো নে মারওয়া দিয়া (রাওয়ালপিন্ডিতে বসে হারামজাদারা আমাদের মেরে দিল)।’
কর্নেল সাদিক তখন হামাগুড়ি দিয়ে নিয়াজির কাছে গিয়ে বললেন, ‘স্যার প্লিজ, কন্ট্রোল কারে আপনে আপকো। সিভিলিয়ানস দেখ রাহে হ্যায়। (স্যার আপনি নিজেকে সংবরণ করুন, বেসামরিক কর্মকর্তারা দেখছেন)।’
নিয়াজি তখন রেগে বলে ওঠেন, ‘ক্যায়া খাক কন্ট্রোল কারু? ‘ঝুট বোল রাহে হ্যায় ইয়াহিয়া সাব। ইয়েলো ফ্রম দ্য নর্থ-হোয়াইট ফ্রম দ্য সাউথ (নিজেকে কী সংবরণ করব? উত্তর থেকে হলুদ আর দক্ষিণ থেকে সাদা আসছে বলে জেনারেল ইয়াহিয়া মিথ্যা বলেছেন।)
এ কথা বলে নিয়াজি আবারও কাঁদতে শুরু করেন।
কর্নেল সাদিক সালিক তাঁর (নিয়াজি) কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘হ্যাঙ্কি ইসতেমাল কারে’ (আপনার রুমাল ব্যবহার করুন)।
জেনারেল নিয়াজি তখন নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন, মুখ মুছে নিলেন এবং টেবিলের নিচ থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গভর্নর সাহাব আপ ঠিক হ্যায়?’ (গভর্নর সাহেব আপনি ঠিক আছেন?)
গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিক প্রচণ্ডভাবে কাঁপছিলেন।
তিনি নিয়াজিকে বলেন, ‘জেনারেল নিয়াজি সাহাব, আপ লড়নেকা শখ ফরমাতে হ্যায়, আপ লড়ে। ম্যায় তো সিভিলিয়ান হু অর ইয়ে মেরে বাস কা নেহি’ (জেনারেল, আপনার লড়াই করার শখ, আপনি লড়ুন। আমি বেসামরিক মানুষ, আর এটা আমার কাজ নয়)।
এরপর টেবিলের নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপরে থাকা একটি কাগজ টেনে নেন গভর্নর। ভীষণ কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খান বরাবর তাঁর পদত্যাগপত্র লিখে সই করেন। পদত্যাগপত্রটি নিয়াজিকে দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়াজি সাহেব, এটা আমার পদত্যাগপত্র। আমি এখনই আমার পরিবার নিয়ে নিরপেক্ষ জায়গা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সরে যাচ্ছি।’
দূর থেকে বিমান হামলা শেষের সাইরেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। আশ্বস্ত হয়ে টেবিলের নিচে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিরা বেরিয়ে আসেন।
নিয়াজি সবার উদ্দেশে বলেন, দয়া করে বসুন। তিনি তখনো প্রচণ্ড কাঁপছিলেন, তবে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন। সম্মেলনকক্ষটি পুরোপুরি তছনছ অবস্থা। এখানে–সেখানে পড়ে ছিল ভাঙা ঝাড়বাতি, খসে পড়া পলেস্তারা। বিস্ফোরকের ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।
গভর্নর বলেন, ‘আপ ব্যাঠিয়ে’ (আপনারা বসুন)। তিনি মাদুর বিছিয়ে, মাথায় রুমাল বেঁধে নামাজ আদায় করেন। এরপর কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তিনি তাঁর এডিসির সঙ্গে বেরিয়ে যান। বিদেশি নাগরিকদের জন্য নিরপেক্ষ অঞ্চল ঘোষিত ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উদ্দেশে রওনা হন তিনি।
এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চপর্যায়ের পাকিস্তানি কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়ার মুহূর্ত। সেদিন ভারতীয় বিমানবাহিনী গভর্নর হাউসের সম্মেলনকক্ষের বিশাল জানালা দিয়ে ১১৮টি রকেট ছুড়েছিল। গভর্নর হাউসে বৈঠকে উপস্থিত পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সেদিন কোনোরকমে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তবে এ ঘটনাটি তাদের পুরোপুরি কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে এই উপলব্ধি জন্মেছে, এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক কঠিন।
নিয়াজি সেদিন গভর্নর হাউসে অসহায়ভাবে যখন কাঁদছিলেন, তাতে বোঝা গিয়েছিল আগের আট মাসের পুঞ্জীভূত চাপের চড়া মূল্য এটি। এই বিমান হামলা এবং অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর বাকি যা পরিকল্পনা ছিল, সেগুলোকেও তছনছ করে দিয়েছে। নিয়াজি সেদিনই মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরাজিত হয়ে গেছেন।
১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অবিরাম বিমান হামলা ঠেকাতে নিয়াজি তাঁর সদর দপ্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরিয়ে নেন। মুক্তিবাহিনী তা জানতে পারে। ভারতীয় বিমানবাহিনী সেখানেও হামলা চালায়। এবার ২৮ স্কোয়াড্রন চারটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের প্রতিটি দুবার করে অভিযান চালায়। এগুলো নিয়াজির নতুন সদর দপ্তরে ২৫৬টি রকেট ছুড়েছিল। বিস্ফোরণ আর দুর্দশার মাত্রা ছিল ভয়াবহ।
আসল কথা হচ্ছে, ‘সরাসরি শত্রুপক্ষের কেন্দ্রস্থলে হামলা’ তত্ত্বটি বেশ ভালোই কাজ করেছে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কেন্দ্রকে লক্ষ্যবস্তু করা গেছে। এতে ঢাকায় পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। তাদের স্নায়ু অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। তাদের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়েছিল। তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছাশক্তি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
অনুবাদ: ফাহমিদা আক্তার