সমন্বয়কদের নিয়ে ডিবিপ্রধানকে ৩ প্রশ্ন করে যে জবাব পেলেন সোহেল তাজ

ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। আজ সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকেছবি: খালেদ সরকার

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে দেখতে গিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। কখন এই সমন্বয়কদের ছাড়া হবে, সে বিষয়েও কোনো সদুত্তর পাননি তিনি।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ আজ সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে যান। প্রায় দেড় ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন তিনি।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সোহেল তাজ বলেন, বিবেকের তাড়নায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের খোঁজ নিতে এসেছিলেন তিনি। ওই সমন্বয়কদের কেন এখানে আনা হয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না এবং কখন মুক্তি দেওয়া হবে—এসব বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কোনো প্রশ্নেরই সন্তোষজনক জবাব পাননি।

ডিবিপ্রধানের কাছে তিনটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলেন জানিয়ে সোহেল তাজ বলেন, ‘আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, এই সমন্বয়কারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাকি নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যদি গ্রেপ্তার হয়ে থাকে, তাহলে আমার কোনো দাবি নেই। কিন্তু যদি নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ডিবিপ্রধান আমাকে পরবর্তী সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছেন, এই ছয় সমন্বয়কারী যেহেতু তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, সেই কারণে তাঁদের নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

সোহেল তাজ আরও বলেন, ‘এই কথা শুনে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, “আপনারা কীভাবে বুঝলেন তারা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা কি আপনাদের জানিয়েছিল, অনুরোধ করেছিল?” আমাকে তখন তিনি বলেছেন, না। ওনারা বুঝতে পেরেছেন মনিটরিং (নজরদারি) করে। যেহেতু নিরাপদ হেফাজতে আছে, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্রত্যুত্তরে আমাকে জানানো হয়, দেখা করতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে দেখা করতে হবে।’

সোহেল তাজ বলেন, ‘আমার তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, সমন্বয়কদের কখন নিরাপদ হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হবে? জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে নির্দেশনা দেবেন, তখনই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।’

নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাত সমন্বয়ক বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে আছেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে সেখানে চিকিৎসাধীন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ তিন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে আসেন ডিবির কর্মকর্তারা। পরের দুই দিন আরও বাকি সমন্বয়কদের তুলে আনেন তাঁরা।

গতকাল রাতে নাহিদসহ ছয় সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় তাঁদের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কাছাকাছি সময় ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ এক ফেসবুক পোস্টে এই সমন্বয়কদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার ছবি দিয়েছেন। আজ হাইকোর্টে একটি রিটের শুনানিতে এ প্রসঙ্গ উঠলে আদালত বলেছেন, ‘এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’

গোয়েন্দা পুলিশপ্রধানের ওই ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে নানা মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ছয় সমন্বয়কের কর্মসূচি প্রত্যাহারের বার্তার সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন এই আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক।

এ প্রেক্ষাপটে ডিবি কার্যালয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে সোহেল তাজ বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দেশে অশান্তি বিরাজ করছে। এখানে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। নিরীহ পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৮–১০–১৫–১৬ বছরের ছাত্র, সাধারণ মানুষসহ অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এটা আমাদের সবাইকে আহত করেছে। আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই বিবেকের কারণেই ব্যক্তিগতভাবে ডিবি অফিসে এসেছি।’

ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। আজ সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে
ছবি: খালেদ সরকার

সমন্বয়কদের বিষয়ে প্রশ্ন রেখে সোহেল তাজ বলেন, একজন নাগরিক যদি অনুরোধ করে, তাহলে নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অনুরোধের বাইরে যদি নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া হয়, তাহলে এটা কি নিরাপদ হেফাজত নাকি গ্রেপ্তার?

সোহেল তাজ বলেন, ‘এই ছাত্র আন্দোলন ঘিরে যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কিছুই নয়। ক্ষয়ক্ষতি কোনো বিষয় নয়। যে সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো তো জনগণের করের টাকায় করা হয়েছে। এগুলো জনগণের সম্পদ। এগুলো হয়তো ভবিষ্যতে আবার গড়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু একটি প্রাণ যেটা আমরা হারিয়েছি, একটি প্রাণও কি আমরা ফেরত পাব? এই প্রাণ কি ফিরে আসবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, মুখ্য জিনিসটা কী? প্রাণের মূল্য কিন্তু কোটি কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে সোহেল তাজ বলেন, ‘আমাদের ছাত্রছাত্রী ভাইবোনের বুকে যাতে আর একটাও গুলি না যায়। আপনারা বিরত থাকুন। এটা ঠিক নয়।’

চলমান পরিস্থিতিতে সরকার কোনো ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল তাজ বলেন, ‘এখানে সমূহ সমাধান প্রয়োজন। সমাধানের প্রথম কাজ যেটা করতে হবে, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্টভাবে স্বতন্ত্রভাবে তদন্ত করে বিচার করতে হবে। এগুলোর জন্য যারা দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড করা যাবে না। এই সমাধান রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। সমাধান সবাইকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে।’

আন্দোলনকারীদের প্রতি তাঁর কোনো বার্তা আছে কি না, এমন প্রশ্নে সোহেল তাজ বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন যেন বিনষ্ট না হয়। এই দেশ তোমাদের। এই দেশ তোমাদেরই গড়তে হবে। ডু নট লুজ হোপ (আশা ছেড়ো না)। সামনে ভালো দিন আসবে, আশা ছাড়া যাবে না। এই দেশ তোমাদের সম্পদ। তোমাদেরই গড়তে হবে।’