অনেক স্থানে চুলা জ্বালাতে রাতের অপেক্ষা, গ্যাস নিয়ে সামনে আরও ভোগান্তি

শীতে চাহিদা কমলেও গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্প-আবাসিক গ্রাহকেরা। এখন চলছে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তৎপরতা।

জ্বলে না গ্যাসের চুলা। থাকতে হয় গ্যাস আসার অপেক্ষায়ছবি: সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের ব্যাপক সংকটে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। অনেক জায়গায় দিনের বেলায় গ্যাস থাকছে না। রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্পের গ্রাহকেরাও। ফলে রপ্তানিমুখী কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

সাধারণত শীতের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়। এতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমে যায়। ফলে শিল্প, আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবার গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন টানা কমছে। ফলে শীতেও গ্যাস–সংকট ভোগাচ্ছে গ্রাহকদের। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, সামনে এটি আরও ভোগাবে।

দিনে এখন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হলে পরিস্থিতি সামলানো যায়। তবে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুট।

দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো। ২০১৮ সালের পর থেকে উৎপাদন কমতে থাকে। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় গত আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোয় তেমন জোর দেওয়া হয়নি। ফলে উৎপাদন কমে এখন ১৯৩ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। গত বছরও এটি ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা এর জন্য দায়ী। সর্বোচ্চ মজুত থাকার পরও কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে তিতাস ও কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। অথচ কম মজুত থাকা বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এখন তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। সর্বশেষ উন্মুক্ত দরপত্রে কোনো কোম্পানি সাড়া দেয়নি। এখন নতুন করে আবার দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। আগামী কয়েক বছরেও সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কারের সুযোগ নেই। স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে তেমন গতি নেই। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানোর কাজ চলছে ধীরগতিতে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি কূপ খননের কথা থাকলেও তিন বছরে হয়েছে মাত্র ১৬টি।

রাজধানীতে চলছে গ্যাস–সংকট। বাসাবাড়ির পাশাপাশি সিএনজি স্টেশনগুলোতেও সব সময় থাকছে না গ্যাস। ‘গ্যাস নেই’—এমন নোটিশ টাঙিয়ে রাখতে দেখা যায় কিছু সিএনজি স্টেশনে। গতকাল বেলা একটায় তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাইলেই চট করে গ্যাসের সংকট সমাধান করা যাবে না। উৎপাদন কমছে, এলএনজি আমদানির সক্ষমতাও সীমিত; আবার এলএনজির দামও বাড়তির দিকে। দেশে উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোনো সমাধান নেই। তাই অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে।

চুলা জ্বালাতে রাতের অপেক্ষা

রাজধানী ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাস না পাওয়ার ফোন আসছে তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা লাইজু বেগম বলেন, রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। শুধু মোহাম্মদপুর নয়; ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার মানুষ গ্যাসের অভাবে রান্নার চুলা জ্বালাতে পারছেন না।

গাজীপুরেও গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারছেন না আবাসিক গ্রাহকেরা। কোথাও কোথাও জ্বলছে না রান্নার চুলা, আবার কোথাও কোথাও আগুন থাকলেও তা কোনোরকমে মিটমিট করছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন গাজীপুর মহানগর, সদর ও কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও।

নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ, দাতা সড়ক, কাশিপুর, বাবুরাইল, ভোলাইল, বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া, মদনপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের সংকটের খবর পাওয়া গেছে। দেওভোগ এলাকার গৃহিণী আফরোজা খানম বলেন, প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টার পর থেকে গ্যাসের চাপ কমে যায়। বেলা একটার পর একটু চাপ বাড়ে। ইলেকট্রিক চুলায় রান্না করায় বাড়তি বিদ্যুৎ বিলে সংসার খরচ বাড়ছে। শহরের বাবুরাইল এলাকার গৃহিণী স্নেহা আক্তার বলেন, দিনের বেলায় গ্যাস মিলছে না। গভীর রাতে গ্যাস এলেও আবার ভোরে চলে যায়। গ্যাস না থাকায় বাড়তি খরচ করে এলপিজি সিলিন্ডার দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে।

গ্যাস পাচ্ছে না শিল্প, দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ হয় শিল্পে। শীতে এমনিতেই গ্যাসের চাপজনিত সমস্যা থাকে। এবার সরবরাহ কম থাকায় এটি আরও ভয়াবহ হয়েছে। কোনো কোনো কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। এতে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। রপ্তানি শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিতি নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ধুঁকছে অধিকাংশ কারখানা।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত ফেয়ার অ্যাপারেলস ডাইং ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, যতটুকু গ্যাস পাচ্ছেন, তা দিয়ে ধীরে ধীরে বয়লার চলছে।

আইএফএস প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এস এম আজমল হুদা বলেন, মাঝেমধ্যেই গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। তখন সিএনজি ও ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।

টোটাল ফ্যাশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবিরুল ইসলাম বলেন, গ্যাস–সংকটে দুই বছর ধরে তাঁদের ডাইং প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

গাজীপুরেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমেছে। কোনাবাড়ী, মৌচাক, ভোগড়া, বাসন, পল্লী বিদ্যুৎ, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর শিল্প এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, এসব এলাকার শিল্পকারখানায় তিন মাস ধরে তীব্র গ্যাস–সংকট চলছে। এক সপ্তাহ ধরে গ্যাস নেই বললেই চলে। ভোগড়া, কোনাবাড়ী, মৌচাক, সফিপুর ও চন্দ্রা এলাকার সুতা তৈরির কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পে গ্যাস–সংকটে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোশাকশিল্প কারখানা।

তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপক (সরবরাহ এবং বিতরণ) মো. রেদওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে গতকাল চাহিদা ছিল ৬০ কোটি ঘনফুট, এর বিপরীতে পাওয়া গেছে ৪১ কোটি ঘনফুট।

গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর নামে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। এখন আবারও সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে দাম বাড়ানোর তৎপরতা চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। নতুন শিল্পের জন্য প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা।

মজুত ফুরাচ্ছে, উৎপাদন কমছে

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। তবে উৎপাদনের শীর্ষে থাকা বিবিয়ানার মজুত শেষের দিকে। এখানে উৎপাদন কমছে। দুই বছর আগে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটও উৎপাদন করা হয়েছে। এখন এটি নেমে এসেছে ৯৮ কোটি ঘনফুটে। আগামী দিনে আরও কমতে থাকবে। অন্য বড় গ্যাসক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন হচ্ছে না।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত নভেম্বর পর্যন্ত মোট মজুত আছে সাড়ে ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। বছরে গড়ে পৌনে ১ টিসিএফ গ্যাস উৎপাদন করা হয়। এতে অবশিষ্ট মজুত দিয়ে ৮ বছর উৎপাদন ধরে রাখা যেতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুতে কত বছর চলবে, তা এভাবে বলা যাবে না। কেননা গ্যাসের মজুত কমতে থাকায় একই হারে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাবে না। এটি প্রতিবছর কমতে পারে। এর মধ্যে নতুন মজুতও আবিষ্কৃত হতে পারে।

আমদানিনির্ভরতা থেকেই বিপর্যয়

উৎপাদনের পাশাপাশি কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ করা হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি থাকায় নিয়মিত গ্যাস–সংকটে ভুগছেন বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও আবাসিক খাতের গ্রাহকেরা। এর মধ্যে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য একটি টার্মিনাল শুক্রবার দুপুর থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে গ্যাস–সংকট আরও বেড়েছে। গত সপ্তাহেও এটি তিন দিন বন্ধ ছিল। এর আগে গত বছর টানা কয়েক মাস বন্ধ ছিল সামিটের টার্মিনাল। কোনো টার্মিনাল বন্ধ থাকলেই গ্যাসের সরবরাহ সংকট বেড়ে যায়।

দিনে চাহিদার ২৫ শতাংশ আসে এলএনজি থেকে। বর্তমানে দিনে আমদানি সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। নতুন করে কোনো টার্মিনাল নির্মাণ হচ্ছে না। তাই দেশে উৎপাদন কমলেও এলএনজি আমদানি খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। যদিও ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর একাধিক চুক্তি করে গেছে গত সরকার।

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সরকারই গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেয় না। আমদানিনির্ভরতা থেকেই এ খাতে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এলএনজিনির্ভরতা কোনো সমাধান নয়। বাজারে থাকলেও চড়া দামে এলএনজি কেনা কঠিন। গ্যাস সমস্যার সমাধান চাইলে অনুসন্ধানে জোর বাড়াতে হবে।

 [প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গাজীপুরনারায়ণগঞ্জ]