৮ ডিসেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান, সার্বক্ষণিক সদস্য ও নতুন পাঁচ অবৈতনিক সদস্য নিয়োগ পেয়েছেন। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন কমিশনের সাবেক সার্বক্ষণিক সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি নাছিমা বেগমের স্থলাভিষিক্ত হলেন। তাঁরা দুজনই সাবেক সচিব। নাছিমা বেগমের আগে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সচিব কাজী রিয়াজুল হক। নতুন সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজাও একজন সাবেক সচিব।
গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি পদে আমলাদের এই আধিক্যের কারণে হয়তো মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছিলেন, মানবাধিকার কমিশন একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মানুষ এখন মনে করে। সময়ের অগ্রগতিতে একটি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে যাওয়ার কথা। বাস্তবে কমিশনের গতি কমে গেছে। (প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর ২০২১)
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির সমান বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর সার্বক্ষণিক সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতির সমান বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পান। ২০২০-২১ অর্থবছরের কমিশনের জন্য বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
জাতীয় সংসদের স্পিকারের সভাপতিত্বে গঠিত সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯-এ ‘চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের নিয়োগ, মেয়াদ, পদত্যাগ, ইত্যাদি’ শিরোনামে ৬(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইন বা বিচারকার্য, মানবাধিকার, শিক্ষা, সমাজসেবা বা মানবকল্যাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখিয়াছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য হইতে চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, এই ধারার বিধান সাপেক্ষে, নিযুক্ত হইবেন।’ বাছাই কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজনের নাম সুপারিশ করবে আইনে এমন বিধানও রয়েছে। তবে এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে আইন অনুসরণ করা হয় না বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে আসছে।
আইনের দুর্বলতা, নাকি কমিশনের অনিচ্ছা
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ‘ক্রসফায়ার’, গুম, বিনা বিচারে আটক, হেফাজতে নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনকে এসব গুরুতর অভিযোগ নিয়ে তেমন কিছু করতে দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে কমিশনের পক্ষ থেকে আইনি দুর্বলতার কথা বলা হয়। কখনো কখনো যুক্তি দেওয়া হয়, কমিশন সরকারি অন্য যেকোনো সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে শুধু প্রতিবেদন চাইতে পারে। নিজেদের তদন্ত করার সুযোগ নেই।
কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কমিশনের কাজ করার সুযোগ আছে। যেমন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯-এর ১৮(১), ১৮(২), ১৮(৩), ১৮(৪) ও ১৮(৫) উপধারার বিধানসমূহ অন্যান্য বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলে তা বোঝা যায়। প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন সরকারকে সময় বেঁধে দিতে পারে। ১৮(৩) (খ) উপধারা অনুযায়ী ভুক্তভোগীকে সাময়িক সাহায্যের সুপারিশ করতে পারে। সরকারের কাছ থেকে প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর সন্তুষ্ট না হলে কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়।
প্রতিবেদন চাওয়া ও প্রতিবেদন পর্যালোচনার মধ্যেই রয়েছে কমিশনের ‘বিশেষ ক্ষমতা’। কিন্তু সেই প্রতিবেদন চাওয়ার প্রক্রিয়ায় আমাদের কমিশন প্রয়োজনীয় সাহস ও দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে কি না, সেটাই হলো প্রশ্ন।
মানবাধিকার কমিশন ‘একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা’ হওয়ার কথা। কিন্তু আমলানির্ভরতা এবং আইনের দুর্বলতার দোহাই দিয়ে সংস্থাটি উল্টো দিকে চলছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবাধিকার সব সময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাদের মানবাধিকার কমিশন সেই গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারছে না।