মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা কী কী সুবিধা পান
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেবেন। নতুন মন্ত্রিসভার ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও ১৪ জন প্রতিমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী কী কী সুবিধা পান, তা জানার আগ্রহ অনেকের। গাড়ি, বাড়ি, চিকিৎসা খরচসহ অন্তত ১৩ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন তাঁরা। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তা নির্ধারণ করা আছে ‘দ্য মিনিস্টার্স, মিনিস্টার্স অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টার্স (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ) অ্যাক্ট’-এ।
বেতন ও বাড়িভাড়া
একজন মন্ত্রীর মাসিক বেতন ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। প্রতিমন্ত্রীর বেতন ৯২ হাজার ও উপমন্ত্রীর ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা। দায়িত্ব পাওয়ার পর একজন মন্ত্রী সরকারি ব্যয়ে একটি সুসজ্জিত বাসভবন পান বিনা ভাড়ায়। প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী একই সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে মন্ত্রী যদি সরকারি বাড়িতে না থেকে নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাহলে সরকার থেকে তিনি মাসিক ৮০ হাজার টাকা করে ভাড়া পাবেন। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পাবেন ৭০ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে বসবাস করলে সেটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে তিন মাসের বাড়ি ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা পাবেন তাঁরা।
এলাকার উন্নয়নে বরাদ্দ টাকা নিরীক্ষামুক্ত
নিজ এলাকার মসজিদ, মন্দির উন্নয়নসহ এলাকার মানুষের দাতব্য কাজে একজন মন্ত্রীকে বছরে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ খাতে প্রতিমন্ত্রী পাবেন সাড়ে ৭ লাখ ও উপমন্ত্রী পাবেন ৫ লাখ টাকা করে। এ টাকার মধ্যে মন্ত্রী চাইলে একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা দিতে পারেন। প্রতিমন্ত্রী দিতে পারেন ৩৫ হাজার আর উপমন্ত্রী ২৫ হাজার টাকা। এলাকার উন্নয়নে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের এই টাকার কোনো নিরীক্ষা হয় না। ফলে এ টাকা খরচে অনেকটা উদার থাকেন তাঁরা।
আপ্যায়ন ভাতা
মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দপ্তরে দেশি-বিদেশি অনেকে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসেন। নির্বাচনী এলাকার মানুষও দেখা করতে আসেন মন্ত্রীর সঙ্গে। তাঁদের আপ্যায়নের জন্য একজন মন্ত্রী মাসে ১০ হাজার টাকা করে পান। এ খাতে প্রতিমন্ত্রী সাড়ে ৭ হাজার টাকা আর উপমন্ত্রী ৫ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। বিমান ভ্রমণের ক্ষেত্রে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বছরে বিমাসুবিধা পাবেন ১০ লাখ টাকা।
চিকিৎসা খরচ সরকারের
মন্ত্রিসভার সদস্যরা অসুস্থ হলে তাঁর পুরো চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করে। এ ক্ষেত্রে বলা আছে, চিকিৎসা খরচ সীমাহীন। সরকার তাঁর পুরো চিকিৎসার খরচ দেবে। তবে খরচের ভাউচার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিতে হবে।
একটি করে গাড়ি সুবিধা
দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সরকারি খরচে একটি করে গাড়ি সুবিধা পাবেন। এই গাড়ি পরিবহন পুল সরবরাহ করবে। এ ছাড়া সরকারি প্রয়োজনে বিশেষ করে নির্বাচনী এলাকায় ভ্রমণের সময় তাঁরা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেকোনো সংস্থা বা দপ্তর থেকে একটি জিপ গাড়ি পাবেন। জ্বালানি বাবদ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ অর্থ পাবেন। তবে দেখা গেছে, মন্ত্রীদের সরকারি গাড়ি তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। মন্ত্রীরা কয়েকটি গাড়ি ব্যবহার করেন, যা বিভিন্ন দপ্তর থেকে নেওয়া হয়।
একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দেশের ভেতরে কোথাও ভ্রমণে গেলে দৈনিক ভাতা পাবেন দুই হাজার টাকা করে। উপমন্ত্রী পাবেন দেড় হাজার টাকা করে।
বাড়ি সাজসজ্জায় প্রতিবছর ৫ লাখ টাকা
সরকারি বাড়ি সাজসজ্জা করতে একজন মন্ত্রী প্রতিবছর পাবেন পাঁচ লাখ টাকা। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা পাবেন চার লাখ টাকা করে। এ ছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বাসভবনে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন ব্যয় যা আসবে, সরকার পুরোটাই বহন করবে।
মন্ত্রী পাবেন ১০ সহায়ক
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তাঁর নিজের পছন্দ অনুযায়ী উপসচিব পদমর্যাদার একজন একান্ত সচিব (পিএস) পাবেন। যদিও গত নির্বাচনের পর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের পিএস নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সেখানে তাঁদের পছন্দ ছিল না। এ ছাড়া একজন সহকারী একান্ত সচিব এবং সরকারি কর্মকর্তার বাইরে নিজের পছন্দের একজন সহকারী একান্ত সচিব পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, একজন জমাদার, একজন আরদালি, দুজন অফিস সহায়ক ও একজন পাচক পেয়ে থাকেন। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী একজন একান্ত সচিব, একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন জমাদার, একজন আরদালি ও একজন অফিস সহায়ক পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা একটি করে মুঠোফোন পাবেন।
মন্ত্রী পদমর্যাদায় চিফ হুইপ ও বিরোধীদলীয় নেতা
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী, চিফ হুইপ ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদটি একজন পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদার। এতে বিরোধীদলীয় নেতা একজন পূর্ণ মন্ত্রীর সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। তিনি একান্ত সচিব (পিএস), একজন সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস), দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, একজন বাহক, দুজন অফিস সহায়ক ও একজন পাচক পান। এ ছাড়া আটজন পুলিশ সদস্য, দুজন গানম্যান সুবিধা দেওয়া হয় তাঁকে। গাড়ির সুবিধাও পেয়ে থাকেন বিরোধীদলীয় নেতা। মন্ত্রীদের মতো বিরোধীদলীয় নেতা সরকারি বাসা পেয়ে থাকেন। সেই বাসার যাবতীয় খরচ সরকার থেকে। এ ছাড়া হুইপ একজন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার।
সংসদ সদস্য যা পান
একজন সংসদ সদস্যের মাসিক বেতন ৫৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি সুবিধা পেয়ে থাকেন। সরকারের কাছ থেকে প্লট পেয়ে থাকেন। আইনপ্রণেতা হলেও এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে গত দুই নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রতিবছর গড়ে পাঁচ কোটি টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বয়স্ক ভাতা, নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ প্রায় ৪০ ধরনের প্রকল্প আছে। সেটির নিয়ন্ত্রণও থাকে সংসদ সদস্যের।
একজন সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার যাওয়া–আসার ভাতা হিসেবে প্রতি মাসে পাবেন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। সম্মানী ভাতা বা আপ্যায়ন ভাতা প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা। মাসিক পরিবহন ভাতা পাবেন ৭০ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচের জন্য প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে লন্ড্রি ভাতা দেড় হাজার টাকা, মাসিক ক্রোকারিজ, টয়লেট্রিজ কেনার জন্য ভাতা ৬ হাজার টাকা, মসজিদ, মন্দির উন্নয়নে বছরে ৫ লাখ টাকা, দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক ভ্রমণ খরচ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, বাসায় টেলিফোন ভাতা বাবদ প্রতি মাসে ৭ হাজার ৮০০ টাকা দেওয়া হয়। তাঁর সব ভাতা করমুক্ত। একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যে চিকিৎসা খরচ পান, একজন সংসদ সদস্য ও তাঁর পরিবার সমান সুবিধা পাবেন।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীরা নিয়মের মধ্যেই সুযোগ–সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে অনেকে এ সুযোগ–সুবিধার অপব্যবহার করছেন। কেউ কেউ আছেন, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা বিক্রি করে দেন। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। তাহলে তাঁদের এত সুযোগ–সুবিধা দিয়ে লাভ কী!