এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা
খাদে পড়া বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না, আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছিল
২০২২ সালে গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় ৩ জন মারা যায়
বাসটির ফিটনেস সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ
চাকার ত্রুটি থাকলে ফিটনেসে নেওয়ার সময় ধরা পড়ার কথা
চালক ঘুমিয়ে পড়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে
এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৯ জন
মাদারীপুরের শিবচরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়া ইমাদ পরিবহনের বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে। গত নভেম্বরেও বাসটি গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় তিনজন মারা যায়। এর পর থেকে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আজ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে এখন পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, এই একই বাস গত ১৭ নভেম্বর রাতে দুর্ঘটনায় পড়ে। গোপালগঞ্জ সদর এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিলে তিনজন মারা যায়। আহত হন আরও ১৫ জন।
বিআরটিএর তথ্যমতে, ভারতের অশোক লিল্যান্ড কোম্পানির বাসটি তৈরি হয়েছে ২০১৭ সালে। এর নিবন্ধন নেওয়া হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। নিবন্ধনে উল্লেখ করা হয় এ বাসের যাত্রী আসন ৪০টি। এরপর প্রায় প্রতিবছরই ফিটনেস সনদ নেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এটি ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে খুলনা পর্যন্ত চলাচলের জন্য অনুমতি (রুট পারমিট) নেওয়া হয়েছিল।
বাসটি চলন্ত অবস্থায় চালক ঘুমিয়ে পড়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হতে পারে বাসের চাকা ফেটে যাওয়া। তবে চাকা ফাটার ঘটনা ঘটলেও অত্যধিক গতিতে বাসটি না চললে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়
বিআরটিএ বলছে, বাসটি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পান্থপথ শাখা ও ইমাদ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির যৌথ নামে কেনা। কোম্পানির মালিক হাবিবুর রহমান শেখ। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের আলিয়া মাদ্রাসা রোডের হারুন টাওয়ারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন এই বাসটি আগেও দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তখন এর চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এরপরও চলাচল করা মহা অন্যায়। এর জন্য বাসের নিবন্ধন বাতিল ও মালিকের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রুট পারমিট দেওয়ার পর সড়কে বাস চলল কি না বা স্থগিত করার পর পুনরায় চলাচল করছে কি না, তা দেখার মতো বিআরটিএর লোকবল বা ব্যবস্থা নেই। পুলিশ চাইলে যেকোনো সময় ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন পুলিশ নীরব থাকলে শাস্তি কার্যকর করা কঠিন।
দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ
আজকের দুর্ঘটনার বিষয়ে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বাসটি চলন্ত অবস্থায় চালক ঘুমিয়ে পড়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হতে পারে বাসের চাকা ফেটে যাওয়া। তবে চাকা ফাটার ঘটনা ঘটলেও অত্যধিক গতিতে বাসটি না চললে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়।
এই বাসটি আগেও দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তখন এর চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এরপরও চলাচল করা মহা অন্যায়। এর জন্য বাসের নিবন্ধন বাতিল ও মালিকের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে
যদি চাকা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সেটি ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় ধরা পড়ার কথা। সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, একটি বাসের ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে অন্তত ৬০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা। এর মধ্যে যানবাহনের ওজন, টায়ারের বিট, গতি ও ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা মূল বিষয়। বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে এই ব্যবস্থা যন্ত্রের সাহায্যে (ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার-ভিআইসি) পরীক্ষা করার সুযোগ আছে। অন্যান্য স্থানে মোটরযান পরিদর্শকেরা খালি চোখে পরীক্ষা করেন। এ ছাড়া যানবাহনের ইমিশন (ধোঁয়া নির্গমন), হেডলাইট, অ্যালাইনমেন্ট, রং, আসন ইত্যাদি পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে।
সরকারি হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় ২ হাজার ৪৬০ জনের। এরপর প্রতিবছরই প্রাণহানি বেড়েছে। এর মধ্যে তিন বছর ধরে প্রাণহানির সংখ্যা চার হাজারের ওপরে উঠেছে।
চাকার ত্রুটি বা অন্য যান্ত্রিক সমস্যা থাকলে তা ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় ধরা পড়ার কথা। কিন্তু বিআরটিএ অধিকাংশ যানবাহনের পরীক্ষার সনদ দেওয়া হয় ৫-১০ মিনিটে। এ ছাড়া অনেক গাড়ি না দেখেও ফিটনেস সনদ দেওয়ার অভিযোগ আছে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মোটরযান পরিদর্শকের সংকটও আছে।
চালকের বিশ্রাম নেই
চালক দীর্ঘ সময় বাস চালিয়ে যাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে না পড়েন, সে জন্য সড়ক পরিবহন আইনে তাদের যথাযথ বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দু-একটা বড় পরিবহন কোম্পানি ছাড়া কেউ এই আইন মানে না।
টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি একজন চালক যানবাহন চালাতে পারবেন না আর বিশ্রাম নিয়ে দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারবেন। ২০১৭ সালে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পরিবহন খাতের ৮৬ শতাংশ শ্রমিক দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানচালকদের টানা দু-তিন দিনও রাস্তায় থাকতে হয়। তাঁরা পরিবহনমালিকের সঙ্গে যাত্রার (ট্রিপ)ভিত্তিতে চুক্তিতে চলেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবহন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না থাকার প্রভাব পড়ছে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। চালকেরা অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় যানবাহন চালানোয় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। টানা যানবাহন চালানোর পেছনে আরও একটি কারণ হচ্ছে চালকের সংকট।
বিআরটিএর হিসাবে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোট মোটরযানের সংখ্যা সাড়ে ৫৬ লাখের কিছু বেশি। মোটরযান চালকের লাইসেন্স আছে ৫০ লাখের কম। অর্থাৎ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যার চেয়েও লাইসেন্স কম। যদিও যত লাইসেন্স, তত চালক নেই। কারণ, একজন ব্যক্তির একাধিক ধরনের লাইসেন্স থাকতে পারে। যেমন কেউ মোটরসাইকেল এবং হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিলে দুটি লাইসেন্স হিসেবে গণ্য হবে। এ বিবেচনায় দেশে যানবাহনের চেয়ে চালকের সংখ্যা অনেক কম। বিআরটিএর হিসাবে, লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। অথচ বিআরটিএর পূর্বাভাস হচ্ছে বর্তমানের হারে নিবন্ধন চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ যানবাহনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ সময় চালকের প্রয়োজন পড়বে প্রায় দেড় কোটি। কারণ, একটি দূরপাল্লার কিংবা বাণিজ্যিক যানবাহনে একাধিক চালক দরকার।
২০১৮ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে চালকদের কর্মঘণ্টা মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশনা দেন। সেটিও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে দিন দিন সড়কে প্রাণহানি বাড়ছেই। সরকারি হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় ২ হাজার ৪৬০ জনের। এরপর প্রতিবছরই প্রাণহানি বেড়েছে। এর মধ্যে তিন বছর ধরে প্রাণহানির সংখ্যা চার হাজারের ওপরে উঠেছে। বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ৭১৩ জনের।