নারিতা ফ্লাইটে প্রতি মাসেই লোকসান ২০ কোটি টাকা

  • প্রথম আট মাসে লোকসান ১৬৬ কোটি টাকা।

  • অর্ধেকের মতো আসন ফাঁকা থাকে।

  • লোকসান হচ্ছে রোম ফ্লাইটেও।

বিমানপ্রতীকী ছবি

ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে জাপানের নারিতা গন্তব্যে ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এরপর প্রথম ৮ মাসেই লোকসান হয়েছে ১৬৬ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ মাসে গড়ে ২০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে।

বিমানের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, টানা লোকসানের কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ ২০০৬ সালে ঢাকা-নারিতা-ঢাকা ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ১৭ বছর পর কোনো বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর আবার নারিতা ফ্লাইট চালু করা হয়। এরই মধ্যে প্রথম আট মাসের যাত্রী পরিবহন, রাজস্ব আয় ও পরিচালনা ব্যয় নিয়ে একটা পর্যালোচনা করে বিমানের সংশ্লিষ্ট শাখা। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিমান মোট লোকসান দিয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার (১৩ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ১৬৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা (তৎকালীন মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী)। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে লোকসান হচ্ছে ২০ কোটি টাকা।

লোকসানের জন্য বন্ধ করা ফ্লাইটটি ১৭ বছর পর আবার চালু করার আগে বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা যায়নি।

এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল বিমানের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নারিতা ফ্লাইট চালুর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখেন বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) সালাউদ্দিন আহমেদ। ওই সময় শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন চলছিল। আর বাংলাদেশ বিমানের বহর মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোয়িং উড়োজাহাজনির্ভর।

ওই সময় ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস কোম্পানি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দেয়। তাদের প্রস্তাবের পক্ষে তখন সক্রিয় ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এ অবস্থায় বিমান কর্তৃপক্ষ নারিতার মতো বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ইতালির রোম ও কানাডার টরন্টোতে ফ্লাইট চালু করে নতুন উড়জাহাজ কেনার প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা করে। এটাকে আবার শেখ হাসিনা সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে প্রচার করে। পরবর্তী সময়ে শফিউল আজিমকে তাঁর ব্যাচের অনেককে ডিঙিয়ে সচিব করা হয়। বর্তমানে তিনি নির্বাচন কমিশনের সচিবের দায়িত্বে আছেন। আর বিমানের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) সালাউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুলাই চাকরি থেকে অবসরে যান।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে শফিউল আজিমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তায় প্রশ্ন পাঠালেও জবাব দেননি।

বিমানের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, টানা লোকসানের কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ ২০০৬ সালে ঢাকা-নারিতা-ঢাকা ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ১৭ বছর পর কোনো বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর আবার নারিতা ফ্লাইট চালু করা হয়।

পরে সালাউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ থেকে তখন সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল।

তাহলে কেন প্রতি মাসে এত বিপুল টাকা লোকসান হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমি অবসরে চলে গেছি। বিষয়টি আমার পুরোপুরি মনে নেই।’ তিনি বর্তমান পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

পরে বর্তমান পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) আশরাফুল আলমকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অল্প কিছুদিন আগে এ দায়িত্বে এসেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবগত নন।

১৯৭৯ সালে বিমানের ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট চালু হয়েছিল। ১৯৮১ সালে সাময়িক বিরতির পর তা আবার চালু হয়। ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০০৬ সালে এই গন্তব্যে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় বিমান। একই কারণে ২০১৫ সালে রোম ফ্লাইট ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত মার্চে নতুন করে চালু করার পর রোম ফ্লাইটেও মাসে প্রায় ১৫ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, এই গন্তব্যে আট মাসে সব এয়ারলাইনসের মোট যাত্রী ছিল ৩৪ হাজার ৮৮৯ জন। আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একক সক্ষমতা হচ্ছে ৫৬ হাজার ৩৬৮ যাত্রী পরিবহনের। ফ্লাইট চালুর আগে এসব পর্যালোচনা করা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমান বাংলাদেশ বোয়িং ৭৮৭-৮০০ উড়োজাহাজ দিয়ে নারিতা ফ্লাইট পরিচালনা করে। এতে আসন রয়েছে ২৭১টি। প্রতি মাসে ফিরতি ফ্লাইটসহ মোট ফ্লাইট থাকে ২৬টি। সে হিসাবে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম ৮
মাসে সর্বোচ্চ ৫৬ হাজার ৩৬৮ জন যাত্রী পরিবহন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এই সময়ে যাত্রী পরিবহন করেছে ২৭ হাজার ৬৯১ জন। অর্থাৎ যে–সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করেছে, তার চেয়ে বেশি আসন ফাঁকা ছিল।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য বলছে, ঢাকা থেকে জাপানের নারিতায় সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে একমাত্র বিমান বাংলাদেশ। এর বাইরে তৃতীয় দেশ হয়ে (ট্রানজিট বা কানেক্টিং) ফ্লাইট পরিচালনা করে আরও আটটি এয়ারলাইনস। উল্লিখিত আট মাসে অন্য বিমান সংস্থাগুলো এই গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করে ৭ হাজার ১৯৮ জন।

দেখা যাচ্ছে, এই গন্তব্যে আট মাসে সব এয়ারলাইনসের মোট যাত্রী ছিল ৩৪ হাজার ৮৮৯ জন। আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একক সক্ষমতা হচ্ছে ৫৬ হাজার ৩৬৮ যাত্রী পরিবহনের। ফ্লাইট চালুর আগে এসব পর্যালোচনা করা হয়নি।

কাউকে জবাবদিহি বা শাস্তির আওতায় না আনায় দিনের পর দিন বিমানে এমনটা চলে এসেছে। এখন সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, আমরা জবাবদিহি আশা করতে পারি। দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিমানে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।
বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন এস এম হেলাল

সাধারণত ট্রানজিট বা কানেক্টিং ফ্লাইট হলে ভাড়া কম হয়। আর সরাসরি ফ্লাইটে একটু বেশি হয়। কিন্তু বিমান সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় আড়াই গুণ কম ভাড়া নির্ধারণ করেছে। বিমানের ভাড়া ছিল গড়ে ২৯১ মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে অন্য এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল গড়ে ৬৮৩ মার্কিন ডলার।

বিমান বাংলাদেশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৮ মাসে এই গন্তব্যে বিমানের আয় হয় ৮ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর খরচ হয়েছে ২১ দশমিক ৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোট লোকসান ১৩ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৬ কোটি টাকা।

কর্তৃপক্ষের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিষ্ঠানকে এমন লোকসানের মুখে ফেলার বিষয়ে বিমানের সাবেক জ্যেষ্ঠ বৈমানিক ও বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন এস এম হেলাল বলেন, ‘কাউকে জবাবদিহি বা শাস্তির আওতায় না আনায় দিনের পর দিন বিমানে এমনটা চলে এসেছে। এখন সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, আমরা জবাবদিহি আশা করতে পারি। দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিমানে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।’