মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি লেখক-শিল্পী বন্ধু

ভালোবাসায় বাড়ানো হাত মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি লেখক-শিল্পী বন্ধু মতিউর রহমান প্রথমা প্রকাশন, ২০২২

‘বাংলাদেশের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা কবি, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ অন্যান্য সৃজনশীল মানুষ। আমাদের লড়াইয়ের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন, আমাদের জন্য তাঁদের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কি আমাদের কিছু করণীয় ছিল না?

‘...স্বাধীনতার পর ঢাকা স্টেডিয়াম বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল মঞ্চে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, লতা মঙ্গেশকর, বব ডিলান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জর্জ হ্যারিসন, অ্যালেন গিন্সবার্গ, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ উপস্থিত হয়ে কথা আর সুরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত
ভুবন রচনা করে তুলছেন। স্বপ্নের মতো হলেও এমন দৃশ্য কল্পনা করে বহুবার আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েছি।’

ভালোবাসায় বাড়ানো হাত গ্রন্থের ভূমিকাংশে এভাবেই নিজের স্বপ্ন-কল্পনার কথা তুলে ধরেছেন লেখক মতিউর রহমান। উল্লেখ বাহুল্য, সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। এখানে নিরুচ্চারে ধ্বনিত হয়েছে আক্ষেপ ও বেদনা। ধারণা করি, এই মনস্তাপ এ গ্রন্থ রচনার অন্যতম প্রেরণা।

একজন সাংবাদিকের দীর্ঘ ও ধারাবাহিক অনুসন্ধিৎসা এবং গবেষকের শ্রম ও নিষ্ঠায় রচিত হয়েছে এ গ্রন্থ। আর পঙ্‌ক্তি-মধ্যে ফাঁকা অংশে অন্তপ্রবাহের মতো আছে আবেগ, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অদ্ভুত অঙ্গীকারে বেঁধেছিল পুরো জাতিকে। আজ আমরা দেখি, গাজায় ইসরায়েলের নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শরিক হয়েছেন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা ইয়েল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। সব ধরনের বাধা বা সতর্কীকরণ, এমনকি নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপেক্ষা করে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছেন ফিলিস্তিনি পতাকা। মনে হয়, যুগে যুগে এভাবেই বিরুদ্ধস্রোতের যাত্রী হয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের শিক্ষিত-সচেতন বিবেকবান মানুষ। এই সমর্থন আমরা দেখেছি ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময়ও। ইতিহাসের কী অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি!

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের অবস্থান সর্বজনবিদিত। কিন্তু সে দেশেরই লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন জুগিয়েছিলেন বাংলার মুক্তিকামী জনগণকে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে শিল্পীদের কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে ধ্বনিত হয়েছিল যে ভালোবাসা ও সমবেদনার সুর, সেই সুর ও সংগীত আন্দোলিত করেছিল সেখানে সমবেত হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাকে। অতঃপর ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’। সারা পৃথিবীর মানুষ জানতে শুরু করল ছোট একটি ভূখণ্ডের কথা, যেখানে মানুষ লড়ছে, মরছে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য।

ভালোবাসায় বাড়ানো হাত গ্রন্থে এমন সব মহান লেখক-শিল্পী বন্ধুর কথা লেখা হয়েছে, যাঁরা দুর্দিনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে। নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি তহবিল গঠন করেছিলেন তাঁরা। চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে, এমনকি পথে পথে নিজেদের আঁকা চিত্রকর্ম বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, পূর্ব বাংলার সহায়-সম্বলহীন লাখো নারী-পুরুষের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, মৃতপ্রায় শিশুটির চোখে জীবনের আলো জ্বালিয়ে রাখা। লেখক সখেদে বলেছেন, ‘আমাদের জন্য তাঁদের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে কি আমাদের কিছু করণীয় ছিল না?’

ছিল তো বটেই, কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সেই অবদান স্মরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেদিক থেকে এ গ্রন্থ ইতিহাসের এক দায়মোচনও বটে। এবং এটিই সম্ভবত এ-বিষয়ক প্রথম ও একমাত্র গ্রন্থ।

ওভাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ‘গুডবাই সামার’ কনসার্টের কথা আমরা কজন জানতাম? আর্জেন্টাইন লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের ভূমিকার কথাও আমরা সেভাবে জানতাম না। বিট প্রজন্মের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’–এর কথা জানলেও রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কির নাম প্রায় অজানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে আমেরিকায় কবিতা পাঠের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন তিনিও। এসব আয়োজন ও অংশগ্রহণের দুর্লভ তথ্যের হৃদয়স্পর্শী উপস্থাপন আমরা পাই ভালোবাসায় বাড়ানো হাত গ্রন্থে।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে লন্ডনের একটি থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি’। সেই অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন, ১৯৭১ সালে অস্কারজয়ী অভিনেত্রী। বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়েও দেখেছি, লেখক গ্লেন্ডা, জোয়ান বায়েজ প্রমুখের পরিচয় তুলে ধরেছেন, যা পাঠকের স্মৃতিসূত্র তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

আসলে মতিউর রহমানের সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধিৎসা বইটিকে অন্য রকম মাত্রা দিয়েছে বলে মনে করি আমরা। বই, পত্রপত্রিকা তো বটেই, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রেও ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছেন লেখক। কখনোবা খুব ছোট একটি সূত্র ধরে দীর্ঘ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র-এর ১৩তম খণ্ডের ৬৫৬ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত দুটি সংবাদের সূত্র ধরে সংগ্রহ করেছেন দুটি বিখ্যাত অনুষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য।

প্রাসঙ্গিক যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এই গ্রন্থে, তার প্রতিটি সূত্র, গ্রন্থকার, প্রতিবেদক বা তথ্যদাতা বন্ধু-স্বজন সবারই নাম উল্লেখ করেছেন লেখক। এতে এই বইয়ের পাঠস্বাদুতা সামান্যও ব্যাহত হয়নি। তবে লেখকের তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণার পরিক্রমা কত আন্তরিক ও দুর্দম ছিল, তা আমরা অনুভব করতে পারব সহজেই।

একটি চমৎকার পরিশিষ্ট অংশ আছে এ গ্রন্থে। এতে পণ্ডিত রবিশঙ্করের স্মৃতিচারণা, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর ধারাবর্ণনা ও অনুষ্ঠানসূচি, ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আয়োজিত কনসার্টের ওপর ক্রিস চার্লসওয়ার্থের একটি সরস প্রতিবেদন ইত্যাদি ছাপা হয়েছে। এই পরিশিষ্ট অংশটি আগ্রহী পাঠকদের সেই সময়টিকে বুঝতে সাহায্য করবে। আর আছে দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র। ছবিগুলো অর্ধশতাধিক বছর আগের অতীতকে যেন মূর্ত করে তোলে আমাদের সামনে।

১৯৭১ সালে অস্ত্রের লড়াইয়ের বাইরেও বাঙালি ও বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের নানা দেশের মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের যে একটি বড় লড়াই ছিল, সেই ঘটনাবলি ও তথ্যে সমৃদ্ধ গ্রন্থ ভালোবাসায় বাড়ানো হাত। তবে এটিকে শুধু কিছু তথ্যের সমাহার ভাবলে ভুল হবে। এর প্রেরণা বা প্ররোচনা এক অভ্যন্তর আবেগ। ভূমিকাংশে লেখক বলেছেন, ‘কলকাতার রবীন্দ্রসদনে সুচিত্রা মিত্র গাইছেন “আমার সোনার বাংলা...”, তাঁর দুই চোখ বেয়ে অবিরল ঝরছে অশ্রুধারা—ঘটনাস্থলে উপস্থিত বন্ধু আবুল হাসনাতের কাছ থেকে শোনা এই আবেগপূর্ণ দৃশ্যের কথা যখনই মনে হয়, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁকে শতবার অভিবাদন জানাই।’

এই আবেগই গ্রন্থটির সম্পদ। কালের ধুলো সরিয়ে সেই সময়টি এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে, যার মতো সুসময় বা দুঃসময় আর কখনোই আসেনি বাংলা ও বাঙালির জীবনে।