আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে মত

  • নির্বাচনী আইনকানুন–বিধিবিধান আরও শক্তিশালী করা, কমিশনের কার্যকারিতা বাড়ানোর পরামর্শ।

  • আইনকানুন–বিধিবিধানের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।

আবদুর রউফ

বিদ্যমান নির্বাচনপদ্ধতির বদলে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আবদুর রউফ। তাঁর মতে, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে মামলা ও অভিযোগ কমবে। এতে আলাদাভাবে আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও প্রয়োজন হবে না। ফলে নির্বাচনী ব্যয়ও কমবে। পুলিশ ও প্রশাসনের বদলে সাধারণ মানুষের মাধ্যমে ভোট পরিচালনা করারও প্রস্তাব দেন তিনি।

গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান আবদুর রউফ। এর আগে ১১ নভেম্বর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়ে বিদ্যমান নির্বাচনপদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছিলেন আরেক সাবেক সিইসি আবু হেনা।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে প্রস্তাব তৈরির কাজ করছে সংস্কার কমিশন। এ জন্য অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে তারা। এর অংশ হিসেবে গতকাল বিকেলে সাবেক সিইসি আবদুর রউফের সঙ্গে এবং এর আগে দুপুরে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংস্কার কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে এবং বিকেলে স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করবে সংস্কার কমিশন।

গতকালের মতবিনিময়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কাছে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন সাবেক সিইসি আবদুর রউফ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি মনে করেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন নেই। যতটা সম্ভব নির্বাচনব্যবস্থাকে সরলীকরণ করতে হবে। মনোনয়ন–বাণিজ্যের প্রথা বন্ধ করা না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এই মনোনয়ন–বাণিজ্যের কারণে সংসদ সদস্যদের চরিত্র নষ্ট হচ্ছে।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির পক্ষে নিজের অবস্থানের কথা তুলে ধরে আবদুর রউফ বলেন, মানুষ ভোট দেবে দলকে, কোনো প্রার্থীকে নয়। এটি হলে প্রার্থীদের টাকা খরচ করার সুযোগ থাকবে না। যে এলাকায় যে দল বেশি ভোট পাবে, সে এলাকায় স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানে তারা প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে পারবে। এটি হলে আলাদাভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার প্রয়োজন হবে না। এতে নির্বাচনের খরচও কমবে।

পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বদলে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করার প্রস্তাব দেন আবদুর রউফ। তাঁর প্রস্তাব হলো ভোটকেন্দ্রগুলো হবে স্থায়ী। ভোটার ক্লাব করা হবে। সেখানে ১১ জনের নির্বাহী কমিটি থাকবে। তাঁরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। ছাত্র-জনতা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবেন।

মানুষ ভোট দেবে দলকে, কোনো প্রার্থীকে নয়। এটি (আনুপাতিক পদ্ধতি) হলে প্রার্থীদের টাকা খরচ করার সুযোগ থাকবে না।
আবদুর রউফ, সাবেক সিইসি

সাবেক এই সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। তারা কীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে।

মতবিনিময় শেষে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা সবার মতামত নিচ্ছেন। এর আগে সাবেক সিইসি আবু হেনা বলেছিলেন, আনুপাতিক পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। কমিশন সবার মতামত শুনছে। অনেক ধরনের মতামত আসছে, অনেক সৃজনশীল, অভিনব প্রস্তাবও আসছে। সব মতামত নিয়ে সেগুলো পর্যালোচনা করে কমিশন তাদের প্রস্তাব তৈরি করবে।

দরকার আইনের প্রয়োগ

গতকাল দুপুরে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংস্কার কমিশন। সেখানে ভোটের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন তা নিশ্চিত করা, নির্বাচন কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, প্রার্থীর এজেন্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব উঠে আসে।

মতবিনিময় শেষে সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনী আইনকানুন–বিধিবিধান আরও শক্তিশালী করা, কমিশনের কার্যকারিতা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ এসেছে। মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ যাঁরাই নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা যেন আরও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বৈঠকে উঠে এসেছে, আইনকানুন–বিধিবিধানের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগ।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান ও আদালতের মাধ্যমে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের একটি রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে তারা বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনও করতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া ছিল।

তবে এটা প্রয়োগের সমস্যা ছিল। এ সমস্যা দূর করতে হবে।

মতবিনিময় শেষে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব শফিউল আজিম সাংবাদিকদের বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা আছে, তাঁরা সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। হস্তক্ষেপ কোথা থেকে, কীভাবে হয়, আইনগত কর্তৃত্বের বাইরে নির্বাচনকে কেউ হস্তক্ষেপ করে, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার আনার জন্য গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করবে এই কমিশন।