অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েই গেল সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন–২০২৩ বাতিল হলেও নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন করে যুক্ত করা সাইবার বুলিং–সংক্রান্ত ধারাটি পূর্ব–অভিজ্ঞতা ফিরিয়ে আনবে। এ ছাড়া মানহানি ও অপমানের মতো বিষয় প্রচারের অভিযোগে মামলা করার ঝুঁকি থাকায় এর অপব্যবহার আগের মতোই হবে।
২৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন হয়। সরকার বলছে, এ অধ্যাদেশ দ্বারা সাইবার স্পেস এবং একই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হবে।
কিন্তু অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদনের আগে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না হওয়ায় এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
সাইবার বুলিংয়ের সঙ্গে মানহানিকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সাংবাদিকদের জন্যও এটা হুমকি তৈরি করবে। এভাবে অধ্যাদেশটি যদি পাস হয়ে যায়, তা হবে হতাশাজনক।জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
গতকাল বৃহস্পতিবার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী জানান, অধ্যাদেশ অনুমোদনের আগে একটি অংশীজন বৈঠক এবং একটি কর্মশালা তাঁরা করেছেন।
অধ্যাদেশটি প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, এতে অপরাধগুলোকে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। সাইবার বুলিং বলা হলেও অনেক অপরাধকে এখানে আনা হয়নি। সাইবার বুলিংয়ের সঙ্গে মানহানিকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সাংবাদিকদের জন্যও এটা হুমকি তৈরি করবে। এভাবে অধ্যাদেশটি যদি পাস হয়ে যায়, তা হবে হতাশাজনক। জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী জানান, তিনিসহ যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, তাঁর জানামতে এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
৮টি ধারা বাদ
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪-এ নিষ্পন্নাধীন কোনো মামলা বা অন্যান্য কার্যধারা, তদন্ত বাতিল হবে এবং কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়া এসব ধারায় আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ড ও জরিমানা বাতিল হবে।
অনুমোদিত খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এতে বিতর্কিত ধারাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আটটি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। ধারাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড; পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ; আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ; অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ইত্যাদির দণ্ড; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদি।
নতুন অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়াখেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুয়াখেলার জন্য কোনো অ্যাপ, ডিভাইস তৈরি বা খেলায় অংশগ্রহণ বা সহায়তা করলে এবং উৎসাহ দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া থাকছে সাইবার স্পেসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশের দণ্ড। এর দায়ে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ড। এখানে সাইবার স্পেসে সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, সব ধরনের ডিজিটাল নেটওয়ার্কগুলো ভার্চ্যুয়াল জগৎ। পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিধানও থাকছে, যা নিয়ে আগেও সমালোচনা ছিল।
অধ্যাদেশে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার রাখা হয়েছে।
এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বচ্ছতার সঙ্গে আইনটি করবে; কিন্তু তারা নিজেদের মতো করে করেছে। আইনটির বহুমাত্রিক প্রভাব এবং বহু অংশীজনও রয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল।টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
অধ্যাদেশে নতুন করে যুক্ত হয়েছে—সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তুর প্রকাশসংক্রান্ত ধারা। এতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো ব্যক্তিকে অপমান, হয়রানি, ব্ল্যাকমেল বা হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনো তথ্য, অশ্লীল ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত বা সম্পাদিত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত বা সম্পাদিত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করলে বা হুমকি প্রদান করলে এবং যা আক্রমণাত্মক, ভীতি প্রদর্শন বা ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদাকে ক্ষতি করে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য অনধিক দুই বছরের জন্য কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য হবে।
এ ধরনের অপরাধ যদি কোনো নারী বা ১৮ বছরের নিচে কোনো শিশুর বিরুদ্ধে হয়, তাহলে ৩ বছর ও ২০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য হবে।
নতুন অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়াখেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুয়াখেলার জন্য কোনো অ্যাপ, ডিভাইস তৈরি বা খেলায় অংশগ্রহণ বা সহায়তা করলে এবং উৎসাহ দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া থাকছে সাইবার স্পেসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশের দণ্ড। এর দায়ে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ড।
সমালোচনার জায়গা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা
অধ্যাদেশের ধারা ২৫–এ সাইবার বুলিংয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা আদান–প্রদান প্ল্যাটফর্ম, ওয়েবসাইট বা সাইবার স্পেসে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি প্রদান বা হয়রানি করা, মিথ্যা বা ক্ষতিকর তথ্য, অপমানজনক বার্তা, গালিগালাজ, গুজব বা মানহানিকর কনটেন্ট ছড়ানোর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির সুনাম বা মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।
এই ধারা আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দেবে বলে মনে করেন মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কে কোন বিষয়কে অপমান হিসেবে মনে করে বসে, এই চিন্তায় মানুষ কথা বলতে চাইবে না এবং সমালোচনার জায়গা সংকুচিত হবে। সাংবাদিকদেরও এই ধারা মাথায় নিয়ে সংবাদ করতে হবে। কারও মানহানি হয়েছে, অপমানবোধ করেছে বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিযোগে মামলার পর পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গিয়ে গ্রেপ্তার করবে। এ ধারার মাধ্যমে আইনটির অপব্যবহারের অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো।
এরশাদুল করিম আরও বলেন, ধারাটিতে শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই এমন তথ্য-উপাত্ত প্রচার বা প্রকাশের প্রসঙ্গ আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ধরনের মিম ঘুরে বেড়ায়, সেটির তো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। সেটি প্রচারের দায়েও তো মামলা হওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। অর্থাৎ মামলার ক্ষেত্রে এটার অনেক ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে যাবে।
এরশাদুল করিম বলেন, সাইবার অপরাধ, সাইবার নিরাপত্তা ও স্পিচ অফেন্সকে (কথা বলার জন্য অপরাধ) গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এত কিছু এক আইনে হয় না।
কে কোন বিষয়কে অপমান হিসেবে মনে করে বসে, এই চিন্তায় মানুষ কথা বলতে চাইবে না এবং সমালোচনার জায়গা সংকুচিত হবে। সাংবাদিকদেরও এই ধারা মাথায় নিয়ে সংবাদ করতে হবে। কারও মানহানি হয়েছে, অপমানবোধ করেছে বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিযোগে মামলার পর পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গিয়ে গ্রেপ্তার করবে।মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম
পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ প্রয়োজন
ব্যাপক সমালোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ রহিত করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার সাইবার নিরাপত্তা ২০২৩ নামে একটি আইন পাস করে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও অধিকারকর্মীরা এটিকে নতুন মোড়কে পুরোনো নিবর্তনমূলক ধারাসংবলিত আইন বলে অভিযোগ করে আসছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ১ ডিসেম্বর আইসিটি বিভাগের ওয়েবসাইটে নতুন অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত চাওয়া হয়। অধিকারকর্মীরা আইনটি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক ও পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়ে এসেছিলেন।
অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদনের আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ১৭ ডিসেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের উদ্দেশে বলেছিল, অধ্যাদেশটি জারির আগে সংশ্লিষ্ট জন কর্তৃক খসড়া পর্যালোচনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য কমপক্ষে এক মাস সময় নেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বচ্ছতার সঙ্গে আইনটি করবে; কিন্তু তারা নিজেদের মতো করে করেছে। আইনটির বহুমাত্রিক প্রভাব এবং বহু অংশীজনও রয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল। টিআইবির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে অনুরোধও জানানো হয়েছে যে অন্তত ১ মাস সময় নিয়ে পর্যালোচনা করতে, কিন্তু তা হলো না। তবে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। চূড়ান্ত হওয়ার আগে যেন সরকার সবার কথা বিবেচনায় নেয়।