জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ভাষা-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার কথাই বলে

সাঁওতাল ব্যান্ড ‘আতমা’র পরিবেশনাছবি: সংগৃহীত

দেশের সব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন হিসেবে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ এলাকার ছবির হাট চত্বরে আয়োজিত হলো ‘বহু ভাষার সন্ধ্যা’। তিন বছর ধরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্যোগে এ আয়োজনটি হয়ে আসছে। এবারের আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল—প্রতিরোধে বাঁচে সংস্কৃতি। নানা জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় লড়াই-সংগ্রামের বিষয়টি প্রাধান্য পায় অনুষ্ঠানে।

বিকেল পাঁচটায় শুরু হওয়া বহু ভাষার সন্ধ্যায় প্রধান আলোচক ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা ইনক্লুসিভিটি শব্দটি বারবার শুনেছি। দেশের সব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে ধারণ করতে না পারলে একটি ইনক্লুসিভ সমাজ কখনো গড়ে তোলা সম্ভব না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সব ভাষার মানুষের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা যেভাবে গুরুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা পায়, বাংলাদেশেও সেটি কেন হবে না? চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান কিন্তু আমাদের এ অনুপ্রেরণা দেয় যে সব ভাষার মানুষ তাঁদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে এ দেশে মাথা উঁচু করে থাকবে। সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।’

দর্শকসারি থেকে উঠে এলেন কৃষক কুদ্দুস মুন্সী। কৃষকদের দুঃখ নিয়ে গাইলেন নিজের লেখা ও সুর করা গান
ছবি: সংগৃহীত

রাত ১১টা পর্যন্ত চলা এ সাংস্কৃতিক আয়োজনে ছিল চাকমা, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাও, উর্দু, হিন্দি, তেলেগু ভাষার বিভিন্ন পরিবেশনা। নিজ নিজ ভাষার মানুষেরা নিজেদের ভাষায় যাঁর যাঁর মতো করে কবিতা, গান ও নাচ পরিবেশন করেন। শুরুতে গিটারে সুর তুলে বাউল গান করেন অনিন্দ্য বিশ্বাস। চাকমা ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করেন কুর্নিকোভা চাকমা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষার অধিকারের বিষয়টি তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারি গান শোনান প্রান্তিক সিকদার উচ্ছ্বাস। অনুষ্ঠানের দর্শকসারি থেকে উঠে এসে কৃষকদের না পাওয়ার বেদনা নিয়ে নিজের লেখা ও সুর করা গান করেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সত্তরোর্ধ্ব বয়সী একজন কৃষক কুদ্দুস মুন্সী।

রাজধানীর তেলেগু সম্প্রদায়ের একটি দল কয়েকটি গান ও নাচ পরিবেশন করে। তেলেগু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের বাইরে আমাদের তেলেগু ভাষায় সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণের কোথাও সুযোগ হয় না। আমাদের শিশুরা মাতৃভাষায় পড়াশোনাও করতে পারে না। তেলেগু ভাষায় পাঠ্যপুস্তক থাকলে আমাদের মাতৃভাষা চর্চা আরও শাণিত হতো।’

র‍্যাপার নিজাম রাব্বি ও তাঁর দলের পরিবেশনা
ছবি: সংগৃহীত

গারো, চাকমা, বমসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীদের গানের সুপরিচিত ব্যান্ড মাদল, সাঁওতাল ও ওঁরাও জাতিগোষ্ঠীর ব্যান্ড ‘আতমা’ গান পরিবেশন করে। ব্রিটিশ শাসনের আদিবাসী সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের গারো পিরেন স্নালের বন রক্ষার সংগ্রাম উঠে আসে তাঁদের গানে। এ ছাড়া বাংলাভাষী গানের ব্যান্ড ব্লু, শিল্পী মুয়িজ পারভেজ, র‍্যাপার নিজাম রাব্বি ও তাঁর দল গান পরিবেশন করে বহু ভাষার সন্ধ্যায়। রাজধানীর মিরনজিল্লা হরিজন পল্লির তরুণ আবেদ দাশ হিন্দি ভাষায় নিজের লেখা শের পরিবেশন করেন। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গত বছর মিরনজিল্লার হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করেন তিনি।

দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার ও সংগ্রামের পাশাপাশি পৃথিবীজুড়ে নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতিও সংহতি প্রকাশ করা হয় এ অনুষ্ঠানে। ফিলিস্তিনি গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে গাজার কবি বাসমান দিরাবির কবিতার অনুবাদ পাঠ করেন কবি ও অনুবাদক রাফসান গালিব। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আন্দোলনকে স্মরণ করে আফ্রিকান-আমেরিকান সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ব্লুজ পরিবেশনা করেন ফাদিব। মণিপুর ও ছত্তিশগড়ে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বাংলা রক ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির গান পরিবেশনা ও প্রজেক্টরে ডকুমেন্টারিও প্রদর্শন করা হয়।

রাজধানীর তেলেগু সম্প্রদায়ের যৌথ পরিবেশনা
ছবি: সংগৃহীত

আয়োজকেরা বিভিন্ন পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে এ অনুষ্ঠান আয়োজনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন, ‘ভাষা আমাদের পরিচয় গড়ে তোলে, আর পরিচয়টি আমরা রক্ষা করে থাকি আমাদের ভাষা, ভূমি ও জীবিকার অধিকার রক্ষা করার দ্বারাই। ভাষাকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিম্নবর্গের জনভাষাকে নিয়মিত কোণঠাসা করে ফেলছে। রাষ্ট্র ও সরকারিভাবে বৈষম্যের কারণে পাহাড়-সমতলে নানা দ্বন্দ্ব বা বিরোধ, উচ্ছেদ, কৃষিজমি হরণের ঘটনা ঘটছে। পিছিয়ে পড়া সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ পরিণত হচ্ছে সস্তার মজুরির শ্রমিকে। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার প্রক্রিয়া, যা বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করে। বহু ভাষার সন্ধ্যা শুধু সংস্কৃতির উপরিকাঠামোর বৈচিত্র্য দেখানোর জন্য নয়, এটি সংস্কৃতিকে শোষণের ভিত্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সত্যকে বহু ভাষার সংগ্রাম দিয়ে ঐক্য ও প্রতিরোধকে বেগবান করারই একটি প্রয়াস।’